২০ বছর বয়সী নাতিকে এবারই প্রথম দেখলেন দাদি জরিনা বেগম। জীবনে প্রথমবার ছেলের সন্তানকে সামান্য দূর থেকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছিল দাদির। নাতির প্রতি দাদির অগাধ ভালোবাসা দেখে চোখ থেকে পানি না পড়লেও চোখ দুটি ছল ছল করছিল জামালের। এমনিতে তো জীবনে প্রথমবার দেখা তাদের। তারপরও কেউ কাউকে ছুঁয়ে দেখতে না পারার কষ্টে যেন বারবার মুষড়ে পড়ছিলেন দাদি-নাতি। পাঠক অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, কেন এমন হলো দাদি-নাতির মাঝে? বিস্তারিত জানতে সংবাদের নিচের অংশটুকু পড়ুন।
যুদ্ধের সময় স্বামী-সন্তান কাঁটাতারের ওপাশে ভারতের অংশে চলে যায়। আর জরিনা বেগম তার মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশেই থেকে যায়। অর্থাভাবে কখনও পাসপোর্ট-ভিসাও করা হয়ে উঠেনি তাদের। তবে মোবাইল ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ হতো তাদের মাঝে।
প্রতি বছর পহেলা বৈশাখের পরদিন ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার জগদল সীমান্তে প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসে দুই বাংলার মিলন মেলা। দু’দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এদিন লাখো স্বজন আসে সীমান্তের কাঁটাতারের কাছাকাছি। কাঁটাতার ধরে নানান কথা হয় তাদের মধ্যে। অনেকেই একে অপরকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
অনেকেই আবার খুব চেষ্টা করেন কাঁটাতারের ওপারে থাকা মানুষটির আঙুলটি হলেও ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু কাঁটাতারের মাঝখানের দূরত্ব তাদের মিলনে ব্যঘাত ঘটায়। বাড়িয়ে দেয় তাদের কষ্ট। অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতে এদিন অনেকে খুঁজে পায় না তাদের স্বজনদের, পেলেও মন খুলে কথা বলার আগে সময় শেষ হয়ে যায়। দিন শেষে তৃপ্তির চেয়ে হতাশা ও কষ্ট নিয়েই বাড়ি ফেরে সবাই।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জমেছিল এ মেলা। এ খবর জেনে ২শ’ কিলোমিটার দূর রংপুর থেকে হরিপুর উপজেলার জগদল সীমান্তে ছুটে এসেছিলেন জরিনা বেগম। দেখা করেছেন ছেলের বউ, নাতি ও ছেলের সঙ্গে। কিন্তু মন ভরেনি জরিনা বেগমের।
অনুভূতি জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জরিনা বেগম বলেন, দুই দেশ বিভক্ত হলেও রক্তের বাঁধন ছিন্ন হয়নি। জীবনের প্রথম ২০ বছর পর ছেলে, ছেলের বউ ও নাতিকে দেখে মনটা ভরে গেছে। ছুঁয়ে দেখলে বুকটা হালকা হয়ে যেত।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদিন ভোর থেকে দুই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন এসে জড়ো হন কাঁটাতারের ধারে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ করে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা দুই দেশের লোকজন একে অপরের সঙ্গে দেখা করেন এদিন। স্বজনদের মিলনে আর দুই দেশের অগণিত মানুষের উপস্থিতিতে এখানে এক বিরল দৃশ্যের অবতারণা হয়। যেন এ দিনের অপেক্ষায় সবাই অপেক্ষা করছিলেন। বাংলা বছরের ১ম/২য় দিন এ দেশের মানুষ ওপার বাংলায় থাকা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেন। যারা অর্থাভাবে পাসপোর্ট, ভিসা করতে পারেন না, তারাই মূলত এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেন।
পীরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা হাজেরা বেগম জানান, এবার দেখা করেছেন তার ছোট ভাই মুসার সঙ্গে। ২০ বছর আগে বাবা-মা ও ভাই-বোনদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। ২০ বছর পর আজ ভাই-বোনদের দেখা পেয়ে খুব আনন্দিত তিনি।
ভারতের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে আসা রহিমা, শাকির, মাজেদা, লক্ষীরানী, গিতাদেবী সরেন মাড্ডীসহ একাধিক ব্যক্তি কাঁটাতারের এপার-ওপারে দাঁড়িয়ে নিজ নিজ স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন এবং কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে মিষ্টি ও কাপড়-চোপড় বিনিময় করেন।
ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবি’র পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ হোসেন বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারও নির্বিঘ্নে ও শান্তিপূর্ণভাবে এই মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ উপলক্ষে সীমান্তে বিজিবিসহ পুলিশবাহিনী বিশেষভাবে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে।
জাগো নিউজ এর সৌজন্যে