Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
দক্ষিণ কোরিয়ার মসজিদ
দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল কেন্দ্রীয় মসজিদ

আধুনিক বিশ্বে নাগরিক সুবিধা ও উন্নত জীবনধারার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার সুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। উত্তর-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি কোরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ অংশ নিয়ে গঠিত। সিউল দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। এটি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ধনী শহরের তালিকায় থাকা একটি শহর। আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টারের অনুসন্ধান মতে, দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বমোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ নাস্তিক বা কোনো ধর্মে বিশ্বাসী না হলেও সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধিই পাচ্ছে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় ইসলাম: কোরিয়ার রাজধানী সিউলের টর্চ ট্রিনিটি সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের প্রধান গবেষক জিউন কোয়ান তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেন, নবম শতাব্দীতে সমুদ্রপথে আরব ও ফরাসি বণিকদের কোরীয় উপদ্বীপে আগমনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে ইসলামের অনুপ্রবেশ। তারপর একাদশ শতাব্দীতে আরবের ভিন্ন একটি বাণিজ্যিক গ্রুপ এখানে ব্যবসা করতে আসে। ওই সব বণিক কোরিয়ার কেইসঙ্গ শহরে (বর্তমান উত্তর কোরিয়া) দৈনন্দিন নামাজ আদায়ের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এভাবে দ্বাদশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে ইসলাম সম্পর্কে কোরিয়ানদের পরিচিতি ও কিছুটা সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে জাপান কোরিয়া উপদ্বীপের ওপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করলে এক মিলিয়নের চেয়ে অধিক কোরিয়ান প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীনে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেখানে চাইনিজ মুসলিমদের সঙ্গে তাঁদের দেখাশোনা ও বোঝাপড়া হয়। কয়েক দশক চীনে অবস্থানের ফলে কিছুসংখ্যক কোরিয়ান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কোরিয়া স্বাধীনতা অর্জন করলে ১৯৪৫ সালে তাঁরা নিজ দেশে ফিরে আসেন। ১৯৫০-১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে কোরিয়া যুদ্ধের সময় তুরস্ক দক্ষিণ কোরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল। পাঁচ সহস্রাধিক সৈন্য এখানে প্রেরণ করেছিল। তুরস্কের তখনকার অনুদান কোরিয়াকে ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের কাছাকাছি নিয়ে আসতে বিরাট ভূমিকা পালন করে।

chardike-ad

বর্তমানে কোরিয়ান মুসলিমসমাজকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। সাম্প্রতিককালের এক আদমশুমারি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ায় দুই লক্ষাধিক মুসলমানের বসবাস। তন্মধ্যে ৫০ সহস্রাধিক হলো স্থায়ী কোরিয়ান মুসলমান। (মিডলইস্ট ইনস্টিটিউট)

কোরিয়ানদের ইসলামচর্চা: বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে স্থায়ী ও প্রবাসী মুসলমানরা দক্ষিণ কোরিয়ায় নিজেদের ঈমান ও আমল সংরক্ষণ তথা ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন। এক তথ্য মতে, রাজধানী সিউল, বোসান প্রভৃতি অঞ্চলে বর্তমানে ১৫টি মসজিদ এবং ৬০টি মুসল্লা বা নামাজঘর রয়েছে। ১৯৬৯ সালে কোরিয়ান সরকার প্রদত্ত জমিতে গড়ে ওঠে সিউল কেন্দ্রীয় মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার। সিউল সেন্ট্রাল মসজিদ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম মসজিদ, যা হেনাম-ডং সিউলে অবস্থিত। এ মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে। কয়েকটি মুসলিম দেশের অর্থায়নে মসজিদটি নির্মিত হয়। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯৭৬ সালের ২১ মে। প্রতি শুক্রবার মসজিদ পূর্ণ হয়ে আশপাশের রাস্তাঘাটে মুসল্লিদের উপচে পড়া ভিড় জমে। মসজিদটি এরই মধ্যে বিশ্বের অনন্য সুন্দর মসজিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

তা ছাড়া মুসলমানদের জন্য বিশেষভাবে হালাল গোশত ও হালাল ফুডের ব্যবস্থা রয়েছে। এক ইতাওয়ান শহরেই প্রচুর হালাল রেস্টুরেন্ট ও হালাল গোশতের দোকান গড়ে উঠেছে। আর দ্বিন প্রচারের কর্মে তাবলিগ জামাতের কর্মতৎপরতা বেশ লক্ষণীয় ও প্রশংসনীয়। সিউল সেন্ট্রাল মসজিদে প্রতিবছর তাবলিগের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখান থেকে সারা দেশে, এমনকি বাইরের দেশেও জামাত পাঠানো হয়। জামাতের কাজে তরুণদের সাগ্রহ অংশগ্রহণ বড়ই আশাজাগানিয়া। অন্যদিকে সেখানে দ্বিনি কর্মতৎপরতা পরিচালনার নিমিত্ত কয়েকটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেগুলো মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান পেশ করছে। কোরিয়ান ভাষায় পবিত্র কোরআন অনুবাদ প্রকাশসহ বেশ কিছু প্রকাশনার কাজও তারা যথারীতি আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে।

ইসলামী সংস্কৃতি বনাম কোরিয়ান সংস্কৃতি: মুনা হিউনমিন বেই দক্ষিণ কোরিয়ার একজন সাড়া জাগানো আলোচিত নারী। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ কোরিয়ায় তাঁর জন্ম। বর্তমানে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাস করছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার কিউন স্কুল অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন থেকে ‘সিনোগ্রাফি অ্যান্ড স্টেজ ডিজাইন’-এর ওপর দক্ষতা অর্জন করেন। ২০০৯ সালে মুনা ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন থেকে তিনি বিশেষভাবে কোরিয়ান নারীদের ঐতিহ্যগত পোশাক ‘হান-বক’ নিয়ে গবেষণার কাজ করে যাচ্ছেন। ইসলাম অনুশীলনের ক্ষেত্রে কোরিয়ানদের মানসিক দূরত্ব কমিয়ে আনাই হলো তাঁর মূল উদ্দেশ্য।

মুনা হিউনমিন বেই কোনো এক প্রসঙ্গে বলেন, ‘বহু কোরিয়ান মনে করেন যে ইসলাম হলো মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিনির্ভর একটি ধর্ম! অতএব, তাদের দৃষ্টিতে ইসলাম কোরিয়ানদের ধর্ম হতে পারে না এবং এই ধর্ম কোরিয়ান সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না!

কিন্তু কোরিয়ার বিগত রাজশাসন জসুনের (১৩৯০-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ) সময়ে এমন প্রচুর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল, যেগুলো ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। একজন কোরিয়ান মেয়ে হিসেবে আমি বিশেষভাবে জসুন নারীদের একটি সংস্কৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলাম, সেটি ‘জাং-ওট’ নামে পরিচিত। নারীরা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নিজেদের পুরো শরীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে নিত, এমনকি কখনো মুখমণ্ডলও ঢাকা থাকত। তারা বিশ্বাস করত যে নারী নিজের শরীর ঢাকার মাধ্যমে নিজের এবং নিজের পরিবারের সম্মান ও স্বকীয়তা বজায় রাখবে। প্রকৃতপক্ষে এটা ইসলামের বিধান ‘হিজাব’-এর বাস্তবিক একটি প্রতিচ্ছবি। তাই আমি আমার অঙ্কনশিল্পের মাধ্যমে এই যোগসূত্রটি আঁকতে চেয়েছি। আমি দৃঢ় আশা পোষণ করি যে এই শিল্পায়নের সহযোগিতায় আমি এ কথা ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হব যে মুসলমান ও কোরিয়ানের মধ্যে বহু ক্ষেত্রে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত মিল রয়েছে। অতএব, একজন কোরিয়ান থেকে মুসলমানও হতে পারে!’ (গ্লোবাল ফান্ড ফর উইমেন)

এসব তথ্য ও উপাত্ত এবং উক্তি ও উদ্ধৃতি থেকে প্রতিভাত হয় যে দক্ষিণ কোরিয়া ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য একটি উর্বর ভূমি। পরস্পরের মধ্যে বিবদমান সব শাখাগত মতবিরোধ ভুলে গিয়ে একসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে কাজ করলে দক্ষিণ কোরিয়ায় মুসলমানদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল—এটা জোর দিয়েই বলা যায়।

লেখক: আলোচক, ইকরা টিভি, লন্ডন।