এবার দেশে গিয়ে গ্রামীণ ফোনের একটা সিম কিনেছিলাম৷ শুনেছিলাম, তাদের ইন্টারনেটের গতি সবচেয়ে ভালো৷ নেটওয়ার্কের পরিধিও বিস্তৃত৷ তাই, তাদের দ্বারস্থ হয়েছিলাম৷ তবে সিম কেনা, আর সেটা পরিচালনার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না৷
২০০ টাকা লাগবে, সিম কেনার আগ্রহ প্রকাশের পর বললেন গুলশানের এক দোকানদার৷ আমি বললাম, সিম কখন চালু হবে? তিনি বললেন, সিম চালু আছে৷ পয়সা দেবেন, নিয়ে যাবেন৷ বলেই ছোট্ট একটা কৌটার মধ্যে কাগজে মোড়ানো কিছু একটা হাতে নিলেন তিনি৷
গভীর মনোযোগে দোকানদার কাগজে মোড়ানো বস্তুটি খুলতে লাগলেন৷ স্বচ্ছ প্লাস্টিক টেপ দিয়ে সেটা ভালোভাবেই মোড়ানো৷ খুলতে সময় লাগছে তাঁর৷ জানতে চাইলাম, সিম কেনার রিসিট দিতে পারবেন কিনা৷ পাশে থাকা একটা রসিদ বই দেখিয়ে বললেন, ‘কাগজ দিয়ে দেবো, আপনি লিখে নিয়েন৷’
সেপর্যন্ত সবই ঠিক ছিল, কিন্তু যখন বললাম যে, সিমটা আমার নিজের নামে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, তিনি বেঁকে বসলেন৷ জানালেন, ‘সিম ইতোমধ্যে আরেকজনের নামে রেজিস্ট্রেশন করা আছে৷ নাম বদলানো যাবে না, তবে আজীবন ব্যবহার করা যাবে৷’
আমি কিঞ্চিত চিন্তায় পড়ে গেলাম, গুলশান হামলার পর থেকে সিম নিয়ে নানা কথা শুনেছি৷ এখন এই সিম কার নামে আছে কে জানে৷ বললাম, ভাই, নিজের নামে রেজিস্ট্রেশন না করা গেলে সিম কিনবো না৷ দোকানদার নির্বিকার চিত্তে সিমটি আবার আগের কৌটায় পুরে ফেললেন৷ অন্য এক কাস্টমারের দিকে মনোযোগ দিতে দিতে জানিয়ে দিলেন, ‘দেশি আইডি কার্ড ছাড়া নিজের নামে সিম পাবেন না৷’
আমি হতাশ না হয়ে আরো কয়েক দোকানে ঘুরে জানতে পারলাম, কাস্টমার কেয়ার থেকে বৈধভাবে দেশি আইডি কার্ড ছাড়াও সিম কেনা যাবে৷ কোনো জটিলতা নেই৷ ফলে বেশ খানিকটা ঘুরে সেখানেই হাজির হই৷
সিম পেতে সমস্যা হলো না৷ বরং এসির বাতাসে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ভালোই লাগলো৷ বেশ কিছু টাকাও পুরে নিলাম সিম কার্ডে৷ কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে৷ আধাঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করে দেখি, বেশ কিছু টাকা হাওয়া৷
পরিচিত একজনের কাছে জানতে চাইলাম, কী করবো? তিনি পরামর্শ দিলেন ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনার৷ টাকা আপনার নম্বরে জমা থাকা ব্যালেন্স থেকে নিয়ে নেবে৷ এ সব প্যাকেজ নির্দিষ্ট টাকা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিনতে হয়৷ সেই সময়ের মধ্যে যদি প্যাকেজে থাকা গিগাবাইট শেষ করতে না পারেন, তাহলে সেটা পুনরায় সেই প্যাকেজ না কিনলে বাতিল হয়ে যাবে৷ অর্থাৎ, আপনি একমাসের জন্য দশ গিগাবাইট ইন্টারনেটের একটা প্যাকেজ কিনলে সেটা সেই সময়ের মধ্যেই শেষ করতে হবে৷ যদি দেখা যায়, মাস শেষে তিন গিগাবাইট রয়ে গেছে, তখন সেটা বিসর্জন দিতে হবে৷ আর প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আপনি যদি ইন্টারনেট ব্যবহার অব্যাহত রাখেন, তাহলে সেজন্য প্যাকেজের আওতার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হবে৷
গ্রামীণ ফোনসহ সব মোবাইল নেটওয়ার্কের এমন নানা ইন্টারনেট প্যাকেজ আছে৷ তাদের নিয়মকানুনও অনেকটা একইরকম৷ গ্রামীণ ফোনের অভিজ্ঞতায় আলোকে বলতে পারি, এ সব প্যাকেজ বেশ জটিল৷ আর এই জটিলতায় পড়ে অনেকেই অকারণে টাকা হারান৷
কথা বলার প্যাকেজের কথাই ধরুন৷ একদিন আমার একাউন্ট ব্যালেন্স শেষ হওয়ার পর তাতে নির্দিষ্ট অংকের টাকা ভরলাম৷ এরপর ফোন করতে গিয়ে দেখি ব্যালেন্স নেই৷ দোকানদারের কাছে ফিরে গেলে তিনি বলেন, আপনি যে প্যাকেজ কিনেছেন তা দিয়ে শুধু গ্রামীণ ফোনের নম্বরে ফোন করতে পারবেন৷ বুঝুন অবস্থা, তারমানে এখন আমার পরিচিতদের মধ্যে যাদের শুধু গ্রামীণ ফোন আছে তাদের সাথে কথা বলতে হবে, অথবা সবাইকে অনুরোধ করতে হবে গ্রামীণ ফোন ব্যবহার করতে৷
আবারো বলছি, শুধু গ্রামীণ ফোন নয়, সব মোবাইল সেবাদাতার এরকম নানা প্যাকেজ আছে৷ আর শুধু প্যাকেজের জ্বালা কেনো, রাতবিরেতে ফোন, এসএমএস করে জ্বালাতেও তাদের জুড়িমেলা ভার৷
এক সন্ধ্যায় পরিবারের সঙ্গে ডিনার করছি, হঠাৎ দেখি চার্জে থাকা ফোন বাজছে৷ দ্রুত উঠে ফোন রিসিভ করতেই ওপার থেকে মিষ্টি গলায় একজন কোনো এক প্রতিষ্ঠানের অফারের কথা জানাতে লাগলেন৷ বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিলাম৷ তবে ওপ্রান্তে কোনো বিরক্তি নেই৷ পরেরদিন আবারো এলো সেই ফোন, ভিন্ন এক সময়ে৷ আর এসএমএসতো আছেই, কখনো সরকারি ফর্মান, কখনো নানা লোভনীয় অফার৷ এমনকি যার কোটি টাকার গাড়ি কেনার সাধ্য নেই, তাঁকে সেই গাড়ির দাম এবং ডিসকাউন্টসহ এসএমএস পাঠায় এই সেবাদাতারা৷
এবার আসি জার্মানির অভিজ্ঞতায়৷ আমি যে ফোন ব্যবহার করি সেটির এত প্যাকেজের জটিলতা নেই৷ মাসে নির্দিষ্ট একটি টাকার বিনিময়ে জার্মানির সব ল্যান্ডফোন এবং মুঠোফোনে কথা বলতে পারি বাড়তি কোনো টাকা খরচ না করে, আর তিন গিগাবাইট পর্যন্ত হাইস্পিড ইন্টারনেট পাই, সেটা শেষ হয়ে গেলে ইন্টারনেটে গতি স্লো হয়ে যায়৷ কিন্তু বাড়তি কোনো চার্জ করে না৷ আর আমি যদি নিজে থেকে কোনো বিষয়ে এসএমএস বা ফোন কল না চাই, তাহলে সেটা আমার ফোনে কোনো অবস্থাতেই আসবে না৷
লিখেছেন- আরাফাতুল ইসলাম, সূত্র- ডয়চে ভেলে