Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

saudi‘ছয় লাখ টাকায় সৌদি আরব না এসে যদি দেশেই কিছু করতাম তাহলে একদিন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যেতাম। এখন দেশে টাকা পাঠাব কি, কাজের জন্য ছুটতে ছুটতে জান শেষ।’ বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার জাঙ্গাল গ্রামের মোবারক হোসেন। তিনি বলেন, ‘দালাল আর এজেন্সির কথায় যেন কেউ সৌদি আরব না আসে। দেশেই যেন কিছু একটা করে।’ জাঙ্গাল গ্রামের পিয়ার আলীর ছেলে হাবিবুর রহমান চড়া সুদে ঋণ নিয়ে, বসতভিটা বন্ধক রেখে ছয় লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে সৌদি আরব যান। ১০ মাসেও কাজ না জোটায় সৌদি আরবে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাঁর। ‘ঋণের টাকার জন্য প্রতিদিনই বাড়ি থেকে কান্নাকাটি করে ফোন আসে। অথচ আমার তিনবেলা খাওয়া প্রায় জোটে না।’

সৌদি আরবে সমস্যা আগে থেকেই বাড়ছিল, সেই সাথে এক নির্দেশনা নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সম্প্রতি সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, দেশটির ১২ রকমের দোকানে প্রবাসীরা আর কাজ করতে পারবেন না। এতে লক্ষাধিক বাংলাদেশি চাকরি হারাবেন বলে মনে করা হচ্ছে। সৌদি আরবে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। ১২ ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে ঘড়ি, চশমা, চিকিৎসা যন্ত্রাংশ, গাড়ির যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী, ভবন নির্মাণ সামগ্রী, কার্পেট, গাড়ি ও মোটরসাইকেল, আসবাব, তৈরি পোশাক ও প্রসাধনসামগ্রী, পেস্ট্রি ও ও গৃহস্থালির টুকিটাকি জিনিস। আগামী সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নতুন হিজরি সনের ১ মহররম থেকে এই আইন বাস্তবায়িত হচ্ছে।

chardike-ad

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমস্যা যেহেতু বাড়ছে, এ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের সক্রিয়ভাবে কিছু করতে হবে। বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্সিগুলোকে সরকার নির্ধারিত নীতিমালা মানতে বাধ্য করতে হবে। সৌদি আরবে অনেক বাংলাদেশি অবৈধ ভািসা বাণিজ্য করছে, এটা বন্ধ হওয়া উচিত। তখন অভিভাবসন ব্যয়ও কমে আসবে। সৌদি আরবগামী কর্মীদের কাছ থেকে এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা নেওয়ার সীমা বাংলাদেশ সরকার বেঁধে দিলেও এজেন্সি ও দালালদের কারণে জনপ্রতি সাড়ে পাঁচ লাখ থেকে আট লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। জানা যায়, জমিজমা বিক্রি ও ঋণ করে বিদেশে গিয়ে প্রবাসীদের অনেকে যখন ব্যয় তুলতে পারছে না, মধ্যস্বত্বভোগীরা ঠিকই ফায়দা লুটে নিচ্ছে।

প্রায় দেড় যুগ ধরে সৌদি আরব আছেন নারায়ণগঞ্জের জাঙ্গাল গ্রামের প্রয়াত আবেদ আলীর ছেলে তাহের আলী, রমজান আলী ও মোশারফ হোসেন। রমজান আলী বলেন, ‘সৌদি আরবের আগের অবস্থা নাই। বছর বছর ট্যাক্সসহ নানা খরচ বাড়ছে। এমন নীতি হচ্ছে, সৌদি নাগরিকদের কাজের ক্ষেত্র বাড়ে, সংকুচিত হয় প্রবাসীদের।’ এখন ছয় থেকে সাত লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরব গিয়ে অনেকেই কাজ পাচ্ছে না বলে জানান রমজান আলী। তাহের আলী বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি, তাতে সৌদি আরব আর থাকা যাবে না।’ সাতক্ষীরার কলারোয়ার রুহুল কুদ্দুস  বলেন, ‘সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে সৌদিতে এসে এখন পেটের ভাতের টাকাই উঠাতে পারছি না। বাড়ি থেকে ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দেয়।’ কুদ্দুসের স্ত্রী সাহিদা বেগম বলেন, ‘ঋণ করে টাকা আর জমি বন্ধক রেখে বিদেশে পাঠিয়ে অনেক কষ্টে আছি। পাওনাদাররা প্রতিদিনই এসে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। দালালও এখন ফোন ধরছে না।’ সৌদিপ্রবাসীদের আরো অভিযোগ, ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেতনের কথা বলা হলেও ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার ওপরে বেতন পাওয়া যায় না।

বিদেশগামী কর্মীদের ঝুঁকি হ্রাসে বাংলাদেশ সরকার অভিবাসন ব্যয়ের হার বেঁধে দিলেও এজেন্সিগুলো তা মানছে না। সরকারের নির্ধারিত এ ব্যয় হচ্ছে সৌদি আরব এক লাখ ৬৫ হাজার, মালয়েশিয়া এক লাখ ৬০ হাজার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এক লাখ সাত হাজার ৭৮০, কুয়েতে এক লাখ ছয় হাজার ৭৮০, ওমানে এক লাখ ৭৮০, ইরাকে এক লাখ ২৯ হাজার ৫৪০, কাতারে এক লাখ ৭৮০, জর্দানে এক লাখ দুই হাজার ৭৮০, মালদ্বীপে এক লাখ ১৫ হাজার ৭৮০ ও ব্রুনেই এক লাখ ২০ হাজার ৭৮০ টাকা। বেশি অর্থ নেওয়া ঠেকাতে সার্ভিস চার্জসহ সব অর্থ ব্যাংকের (চেক, ড্রাফট, পে অর্ডার) মাধ্যমে লেনদেন করার কথা থাকলেও গলা কাটা বন্ধ করতে হবে জেনে হাতে হাতে টাকা নিয়ে থাকে রিক্রুটিং এজেন্সি। দেওয়া হয় না রসিদ।

সৌদি আইন হচ্ছে, বিদেশে থেকে শ্রমিক আনতে অর্থ নেওয়া যাবে না। কিন্তু সৌদি নাগরিকরা তা মানছে না।  শুধু ব্যক্তি পর্যায়েই নয়, সৌদি বড় বড় কম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বাংলাদেশের এজেন্সিগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে মোটা অর্থে ভিসা বিক্রি করছে। ফলে অভিবাসন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি ভিসা পেতে এক থেকে দুই লাখ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এজেন্সিও মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। ফলে পাঁচ লাখ থেকে সাত-আট লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে যাচ্ছে সৌদি আরব যেতে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত। সৌদি আরবে কারো বিরুদ্ধে ভিসা কেনাবেচার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ১৫ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু অপরাধরটির নজরদারি নেই।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, ‘সরকারের বেঁধে দেওয়া অর্থের বাইরে কয়েক গুণ বেশি টাকা নিয়ে সৌদিতে কর্মী পাঠানো হচ্ছে। এ জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছি। অনেক ক্ষেত্রে তাদের জামানতের টাকাও কেটে রাখা হয়।’ ভিসা কেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে সৌদিতে গৃহকর্মী ভিসার ক্ষেত্রে টাকা দিয়েও নাকি ভিসা কিনে থাকে। সৌদি আইন অনুযায়ী সৌদির কোনো ব্যক্তি এটা করতে পারে না। উল্টো সৌদি মালিককে শ্রমিক নিতে হলে বিমানভাড়াসহ যাবতীয় খরচ বহন করেই নেওয়ার কথা। কিন্তু উল্টো তাদের টাকা দিয়ে ভিসা কেনা হচ্ছে। যার ফলে অভিবাসন ব্যয় অনেক বেশি পড়ে যাচ্ছে। এটা বন্ধ করতে আমাদের দূতাবাসকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে।’

উচ্চ অভিবাসন ব্যয় প্রসঙ্গে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, ‘এমন অভিযোগ আমরা শুনি কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। সৌদি আরবের নাগরিকদের কর্মক্ষেত্র বাড়ানোর জন্য তারা কিছু নির্দেশনা জারি করেছে। প্রবাসী কর্মীরা কিছুটা চাপে থাকলেও ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় প্রবাসীদের কর্মক্ষেত্র বাড়ছে। সেসব স্থান পূরণ করবে আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিরা। অদক্ষ-আধাদক্ষ কর্মী পাঠানোর পাশাপাশি আমরা এবার গুরুত্ব দিচ্ছি দক্ষ কর্মী পাঠানোর ওপর।’

সূত্র- কালের কণ্ঠ