পণ্যবাহী যানবাহনে চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। দিনদিন চাঁদার পরিমাণ বাড়ছে। প্রায় প্রতিটি মোড়েই চলে চাঁদার জুলুম, হয়রানি। পণ্যবাহী ৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৮৭টি যানবহনকে রাস্তায় প্রতিদিন ১০ কোটি ৬৫ লাখ ৮৬ হাজার ১শ’ টাকা চাঁদা দিতে হয়। রাস্তায় ব্যাপক চাঁদাবাজির কারণে বাড়ে পণ্যের দাম, ভোগান্তিতে পড়তে হয় জনগণকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিছুতেই চাঁদাবাজি কমছে না। চাঁদাবাজি-হয়রানি বন্ধে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ের কার্যকর হচ্ছে না। জেলা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, সার্জেন্টরা মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাস্তায় গাড়ি আটকে চাঁদাবাজি অহরহ ঘটছে। চালকদের সঙ্গে করছে দুর্ব্যবহার ও হয়রানি। পণ্য পরিবহনের নীতিমালাও অনেকটা অকার্যকর। হাইওয়ে পুলিশের চেয়ে জেলা পুলিশের হয়রানি ও চাঁদাবাজির মাত্রা বেশি বলে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন। সারাদেশে কোন কোন পয়েন্টে এবং রাজধানীর প্রবেশ পথে, কোন কোন পয়েন্টে চাঁদাবাজি ও হয়রানি করা হয় শ্রমিক মালিকরা এর বিস্তারিত তথ্য এই প্রতিনিধির কাছে তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে মোট পাকা রাস্তা আছে ২ লাখ ৫২ হাজার কিলোমিটার। এসব রাস্তায় পণ্যবাহী যানবহান চলাচল করে। এরমধ্যে ৮ হাজার ৬০ কিলোমিটার মহাসড়ক। গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বিআরটিএ অনুমোদিত পণ্যবাহী গাড়ির সংখ্যা ৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৮৭টি। গড়ে প্রতিটি পণ্যবাহী যানবাহনকে দিনে ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এরমধ্যে চট্টগ্রাম হাইওয়ের ৫/৬ জায়গা, সিলেট হাইওয়ের ৪/৫টি স্থানে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ২/৩টি স্থানে, বগুড়াসহ ঢাকা-উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ১৪/১৫টি স্থানে, যশোর, খুলনা, রাজবাড়ি, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরাসহ প্রায় ৩৬টি স্থানে চাঁদা দিতে হয়। এসব স্থানে গাড়ি থামিয়ে ২০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়।
এদিকে রাজধানীর ৯টি প্রবেশমুখে পণ্যবাহী যানবাহনকে ২০০/৫০০/১০০০ টাকা চাঁদা দেওয়া অনেকটা ওপেন সিক্রেট। অন্যান্য বিভাগীয় শহরের প্রত্যেকটি প্রবেশমুখেও চাঁদা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। এখানেই শেষ নয়। মহানগরের ভিতরের বাড্ডা, কামারপাড়া, যাত্রাবাড়ি, মত্স্য ভবন, খিলগাঁও, কাওরান বাজার, ফার্মগেটসহ কয়েকটি মোড়ে প্রকাশ্যে পণ্যবাহী যানবাহন থেকে চাঁদা তোলা হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী, ১৫০০ কেজির পণ্যবাহী পিক-আপ দিনের বেলায় রাজধানীতে প্রবেশ করতে পারবে। তারপরেও উল্লিখিত স্থানগুলোতে এ যানেরও চাঁদা না দিলে হয়রানির অন্ত থাকে না। অনেকটা বাধ্য হয়ে চাঁদা দিতে হয়। কাভার্ট ভ্যান রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত ঢাকায় থাকতে প্রবেশ করতে পারবে। কিন্তু যখনই প্রবেশ করুক না কেন পুলিশকে চাঁদা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
মহাসড়কে পুলিশের হয়রানি ও চাঁদাবাজি বন্ধসহ ১২ দফা দাবিতে গত বছর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় পণ্য পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ধর্মঘট কর্মসূচিও পালন করেছে। ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধসহ ১৪টি বিষয় নিয়ে পরিবহন মালিক সমিতির সাথে পুলিশের আইজির বৈঠক হয়। হাইওয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, রাস্তায় কোন পণ্যবাহী যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না। তবে যদি কোন যানবাহনে অবৈধ মালামাল কিংবা বিস্ফোরক দ্রব্যের পূর্বের কোন তথ্য থাকে সেক্ষেত্রে ওই যানবাহনকে তল্লাশি করতে মালিক শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের ডাকতে হবে এবং যানবহানকে পাশের কোন নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। তবে এসব নির্দেশনার কিছুই মানা হচ্ছে না। পরে চাঁদাবাজির নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করে পুলিশ। রেকারের মাধ্যমে ডাম্পিংয়ের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি শুরু হয়। এসব বিষয় নিয়ে সর্বশেষ গত ৪ ডিসেম্বর পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে আইজিপির বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে পূর্বের নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে যথাযথভাবে কার্যকর করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই নির্দেশনা পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রতিটি জেলা পুলিশ সুপার, হাইওয়ে পুলিশ সুপার, ইউনিটগুলোতে পাঠানো হয়। এর আগে ডিআইজি (হাইওয়ে), ডিআইজি চট্টগ্রাম রেঞ্জ, কমিশনার, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার, চট্টগ্রাম জেলা হাইওয়ে পুলিশ, ফেনীর এসপি, কুমিল্লার এসপি, পুলিশের বরিশালের ডিআইজি, রংপুর পুলিশের ডিআইজি, রাজবাড়ির এসপি, মানিকগঞ্জের এসপি, বগুড়া হাইওয়ে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মালিক শ্রমিক নেতারা বৈঠক করেন। কিন্তু কোন কিছুতেই চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর ২/৩ মাস পরিস্থিতি কিছু ভাল থাকে। পরে আবার শুরু হয়ে যায় অসহনীয় চাঁদাবাজি।
পুলিশের আইজি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, মাঠ পর্যায়ে মালিক শ্রমিকদের লোক আছে, পরিবহন শ্রমিকরা আছে। যদি তারা হাইওয়ে বা জেলা পর্যায়ে পুলিশের হয়রানির শিকার হয়। তাহলে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে যে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে সেটা মাঠ পর্যায়ে কোথায় মানা হচ্ছে না সেটা তারা স্থানীয় জেলা এসপি বা হাইওয়ে এসপিকে জানাতে পারে। তাদেরকে সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ দেওয়া আছে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার জন্য। এটা এসপিকে বলার পরও বাস্তবায়ন না হলে আমাকে জানাতে পারে। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, তারা তো কোন অভিযোগ করে না। এতে প্রমাণিত হয় তাদের নিজেদের মধ্যে ঝামেলা আছে। আর পুলিশের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হোসেন আহমেদ মজুমদার জানান, চাঁদাবাজি-হয়রানির বিষয়টি আমরা বহুবার বলেছি। দফায় দফায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। কিন্তু বৈঠকের পর কিছু দিন ভাল থাকলেও পরে একই অবস্থা বিরাজ করে। মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন কোন কথাই শোনে না।
পুলিশের ডিআইজি (হাইওয়ে) আতিকুল ইসলাম জানান, গত তিন মাস ধরে পণ্যাবাহী যানবাহনে চাঁদাবাজি ও হয়রানির কোন অভিযোগ আসেনি। আর যদি হয়েও থাকে তারা বলুক, আমরা ব্যবস্থা নেবে। লক্কর-ঝক্কার, মেয়াদোত্তীর্ণ, যানবাহন এবং ওভার স্পৃিডে গাড়ি চালায় এমন যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এটা তো নিতেই হবে। তিনি বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করা যাবে না। পরিবহনের লোকেরা মালিককে কম টাকা দিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলেন বলে অভিযোগ করেন আতিকুল ইসলাম।