৬৫ ইঞ্চি টেলিভিশন ঘুষ দাবি করার অভিযোগে নরসিংদীর মনোহরদী থানার ওসি গাজী রুহুল ইমামকে ‘ক্লোজড’ করা হয়েছে। উপজেলার চালাকচর বাজারের পোল্ট্রি ব্যবসায়ী মো. আসলাম শেখের কাছে এ ঘুষ দাবি করা হয়েছিল।
গত মঙ্গলবার বিকেলে নরসিংদীর পুলিশ সুপার আমেনা বেগমের নির্দেশে ওসিকে নরসিংদীর পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। গত রবিবার ‘ওসির দাবি ৬৫ ইঞ্চি টিভি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয় এবং ওই নিউজের পাশাপাশি ওসি গাজী রুহুল ও ব্যবসায়ীর কাছে টিভি দাবি করার ফোনালাপও অনলাইনে আপলোড করা হয়। এরপর নরসিংদী জেলার পাশাপাশি তোলপাড় শুরু হয় সারা দেশে।
ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের খবরের পর এলাকাবাসীও তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে। জানতে চাইলে মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘সরকারি দপ্তরের অনেক কর্মচারীই হেনস্তার শিকার হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আমার কাছে অভিযোগগুলো করেছিলেন। একজন সরকারি কর্মচারী হয়েও থানায় বিনা অপরাধে আটক করে নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
এ ঘটনায় গত সোমবার নরসিংদীর শিবপুর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রেজোয়ান আহামেদকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা সিনিয়র এসএসপি রেজোয়ান আহমেদ ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মো. আসলাম শেখের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছেন। বুধবার দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে নরসিংদীর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ব্যবসায়ী আসলাম শেখ ও তাঁর মা মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী সাহেরা বেগমসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেন।
নরসিংদী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) হাসিবুল আলম বলেন, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মনোহরদী থানার ওসি গাজী রুহুল ইমামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাঁকে আপাতত নরসিংদী পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন নরসিংদী কোর্ট পরিদর্শক ফখরুল ইসলাম। আর গাজী রুহুল ইমামের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মনোহরদীর চালাকচর ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুর রহমানের দুই ছেলে আসলাম শেখ ও মো. ছালাম শেখকে ভুয়া ডাকাতির মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে ঘুষ হিসেবে ওই টিভি চেয়েছিলেন ওসি রুহুল ইমাম। দাবি অনুযায়ী টেলিভিশন দিতে না পারায় মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের অশ্লীল গালাগাল করান তিনি। এমনকি টেলিভিশন দিতে না পারলে এলাকা ছাড়া করা এবং ডাকাতি মামলায় জেল খাটানো হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন ওসি। ওই ঘটনার পর ব্যবসায়ী ছালাম শেখ নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার এই সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা।
মুখ খুলছে মানুষ: ‘দেহা করার কথা কইয়া, না হইলে খালি খালি ধইরা থানায় নিয়া মামলার ডর দেহায়। পরে টেহা দিলে কিচ্ছু না। খালি ছাইড়া দেয়।’ মনোহরদী থানার ওসি রুহুল ইমামের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেন মনোহরদীর তামাককান্দা এলাকার আসাদ মিয়া। তিনি জানান, গত ৪ ডিসেম্বর রাত ৯টার দিকে তামাককান্দা এলাকায় নিজ বাড়ির পাশে সহপাঠী সুমন মিয়া, সুজন মিয়া, লিটন মিয়া ও আবদুর রহমান মিলে আড্ডা দিচ্ছিলেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে মনোহরদী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শওকত আসেন এবং তাঁদের একসঙ্গে দেখতে পেয়ে ধরে মনোহরদী থানায় নিয়ে যান। পরে থানায় নিয়ে দুই লাখ টাকা দাবি করে বলা হয়, অন্যথায় জুয়ার মামলায় ফাঁসানো হবে। আত্মীয়স্বজনরা মিলে গভীর রাতে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। আসাদ মিয়া বলেন, ‘আমরা এসআই শওকতরে প্রায় ৭০ হাজার টেহা দেওয়ার পরে ভোরবেলা সবাইরে ছাড়ছে।’
সর্বশেষ গত ৩০ ডিসেম্বর রাতে মনোহরদীর চালাকচর চেংগান এলাকার আবদুল হাই মাস্টারের ছেলে হাদিউল ইসলাম ও ড্রেনেরঘাট এলাকার দুলাল মিয়াকে ওসি রুহুল ইমাম দেখা করার কথা বলে সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহিন মিয়া ও এসআই শওকতের মাধ্যমে দেখা করার কথা বলে থানায় নিয়ে যান। সেখানে রাতভর আটকে রেখে ৩৫ হাজার টাকার বিনিময়ে পরদিন দুপুর দেড়টায় ছাড়িয়ে নিয়ে যান স্বজনরা। হাদিউল ইসলাম বলেন, রাত সাড়ে ১২টার দিকে ওসি সাহেব থানায় এসে বলেন, ‘আমরা নাকি চুরির মালের ব্যবসা করি’ এই অভিযোগে থানা হাজতে আটকে রাখে। পরে ‘আমাদের এলাকার গ্রাম পুলিশ আলাউদ্দিনের মাধ্যমে দুই লাখ টাকা দাবি করে। আমরা দিতে অস্বীকৃতি জানাই। শুনে লেবুতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন, চন্দবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুর রউফ হিরন ভাই দেখা করতে আসেন। সবার পরামর্শে আমি গ্রাম পুলিশ আলাউদ্দিনের মাধ্যমে ১৫ হাজার আর দুলাল চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পাই।’
এ ছাড়া হেনস্তার শিকার হয়েছেন সরকারি কর্মচারীরাও। তাঁদের মধ্যে আছেন উপজেলা প্রকৌশলী অফিসের অফিস পিয়ন শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, শুধু শুধু তাঁকে থানায় ধরে নেওয়া হয়েছিল। শফিকুল বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ, এত টাকা কই থেকে দিমু বলে আকুতি-মিনতি করলেও ছাড়েনি। পওে অনেক কষ্টে ৮২ হাজার ৫০০ টাকা দিই। ওসি নিজে আমার কাছ থেকে টাকা বুঝে নেন। আর একই সময় আমার সঙ্গে স্থানীয় আব্দুল বাতেন মিয়ার ছেলেকেও আটক করে নিয়ে যায়, তাঁর কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা নেয় ওসি। এমন ওসি বিদায়ে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়মু।’
সূত্র: কালের কণ্ঠ