বিশ্বের অন্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে কিলোমিটারপ্রতি রেলপথ নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি। এর কারণ হলো পরামর্শক ও অন্যান্য ব্যয়। পরামর্শকই নিয়ে যায় প্রকল্পের একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ। বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণে প্রতি দেড় কিলোমিটারে একজন করে পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে।
শুধু লাইন নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হবে ২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। আর ৬১ জন পরামর্শকের জন্য ব্যয় হবে প্রায় ৯৬ কোটি টাকা। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দেয়া প্রকল্প-প্রস্তাবনা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের সাথে যোগযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটা প্রকল্প তৈরিতে ব্যয়ের বিশৃঙ্খলা। এভাবে চললে এই লুটপাটের খেসারত দিতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গ থেকে রাজধানী ঢাকার রেলপথের দূরত্ব কমিয়ে সময় হ্রাস করার জন্য বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণের প্রস্তাবনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ভারতীয় তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটে (এলওসি) এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এতে ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ৭১০ কোটি ১৭ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। যার মধ্যে ভারত থেকে ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে তিন হাজার ১৪৪ কোটি ৪০ হাজার টাকা। আগামী ২০২২ সালের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা। তবে প্রকল্পটি এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
প্রকল্প পর্যালোচনায় দেখা যায়, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত ৭৯ দশমিক ৩০ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ এবং ১১ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ লুপলাইনসহ ৯০ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করতে হবে। এতে সার্বিকভাবে ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ৭১০ কোটি ১৭ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এই হিসাবে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় দাঁড়াবে ৬৩ কোটি টাকা। আর প্রকল্পের শুধু ট্র্যাক বা লাইন নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৫৭৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এই হিসাবে প্রতি কিলোমিটার ট্র্যাক নির্মাণ ব্যয় পড়ছে ২৮ কোটি ৪৫ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
৯০ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের জন্য দেশী ও বিদেশী পরামর্শক ধরা হয়েছে ৬১ জন। যাদের পেছনে ব্যয় হবে ৯৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এখানে ১৪ জন বিদেশী পরামর্শক থাকবে। যাদের জন্য ব্যয় হবে ২৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা। তাদেরকে প্রতি মাসে বেতন দিতে হবে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা হারে। প্রকল্পের সহায়ক কর্মচারীদের জন্য ব্যয় হবে ৬৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আর প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে হবে ৯৬০ একর। যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতি একরে দুই কোটি টাকা। জমিতে মোট ব্যয় দাঁড়ায় এক হাজার ৯২১ কোটি টাকা। এখানে ১০টি স্টেশন নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭২ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত ভারতে সাধারণ সিঙ্গেল লাইনের রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে গড়ে ব্যয় হয় ১২ কোটি টাকা। পাকিস্তানে এই ব্যয় কিলোমিটারে ১৫ কোটি টাকা। চীনে ট্রেন চলাচলের জন্য ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিবেগের রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭৫ কোটি টাকা। আর সাধারণ সিঙ্গেল রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বলছে, প্রকল্পটি তৈরির আগে বাংলাদেশ রেলওয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করেনি। তবে ১৯৯০ সালে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত সরাসরি মিটারগেজ লাইন নির্মাণের বিষয়ে লোকেশন সার্ভে করা হয়। ১৯৯৬ সালে এর ওপর ফলোআপ স্টাডি করা হয়। প্রায় ২০ বছর আগে সম্পাদিত লোকেশন সার্ভের ওপর ভিত্তি করে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। কমিশন বলছে, পরামর্শক খাতে প্রতি মাসে জনপ্রতি বেতন হিসাবে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এই খাতের ব্যয়গুলো পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ৬০ জন জনবলের জন্য বেতন ধরা হয়েছে ১২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। জনবল নির্ধারণ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী জনবলের সংখ্যা ও বেতনভাতা নির্ধারণ করতে হবে।
এ ব্যাপারে বিশ^ব্যাংকের ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে প্রকল্প তৈরিতে মান রক্ষা করা হচ্ছে না। যার যা খুশি নিজেদের মতো করে ব্যয় নির্ধারণ করছে। বিদেশে এক টাকার জায়গাতে চার টাকা ব্যয় হলেও কাজ হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে সেটাও হচ্ছে না। এখানে খাতাপত্রে ব্যয় দেখানো হচ্ছে। পরে বিল দিয়ে টাকাগুলো নিয়ে নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বিদেশী ঋণের টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার হলে দেশের প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। এতে করে রাজস্বও বাড়ত। সরকারও সেটা থেকে ঋণ পরিশোধ করতে পারত। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আমরা সক্ষমতা হারাব। বিদেশী ঋণও পরিশোধ করতে পারব না।