নিয়ম অনুসারে ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে পর্যটন মৌসুম। প্রস্তুত করা হয়েছে পর্যটন সেবার প্রয়োজনীয় সব অনুসঙ্গ। নাফনদে এসে গেছে সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে চলমান পর্যটকবাহী জাহাজের কয়েকটি।
এর মধ্যে ২ সেপ্টেম্বর ছিল মুসলমানদের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল-আজহা। পূর্ব নিয়মানুসারে ঈদের ছুটি দিয়েই বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত নগরী কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসা চাঙা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় ২৭ সেপ্টম্বর আড়ম্বরভাবে পালন করা হয় বিশ্ব পর্যটন দিবস। কিন্তু এবার পুরোনো সব চিত্রের ব্যতিক্রম হয়েছে। চলতি রোহিঙ্গা সঙ্কট ধস নামিয়েছে পর্যটন ব্যবসায়। স্থবিরতা এনেছে জেলা প্রশাসনসহ সব বিভাগের স্বাভাবিক কার্যক্রমেও। ফলে অর্থনৈতিক ও আর্থসামাজিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে পর্যটন জেলা কক্সবাজারে, এমনটি মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পর্যটন ব্যবসায়ীদের মতে, যারা ঢাকা-চট্টগ্রাম বা দেশের অন্য এলাকায় বাস করেন তারা বেড়ানোর জন্য ঈদের ছুটিকে কাজে লাগান। আর অপেক্ষা করেন রোদ-বৃষ্টি লুকোচুরি খেলার পর্যটন মৌসুমের শুরুটার। তাই আগে থেকেই হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউসের কক্ষগুলো আগাম বুকিং দেন। কিন্তু চলতি কোরবানির ঈদে যে বুকিং হয়েছে তা যতসামান্যই বলা চলে। এটা বিগত এক দশকের চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। এতে পর্যটন ব্যবসায়ীরা চরম হতাশ।
হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম সিকদার বলেন, ঈদ থেকে শুরু করে এ সময়টা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কক্ষ বুকিং থাকত। কিন্তু পর্যটন মৌসুম চললেও চলতি সময়টা খুবই বাজে যাচ্ছে সবার। হোটেল-মোটেলে যেসব কক্ষ বুকিং হচ্ছে তার দুই তৃতীয়াংশ রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিতে আসা লোক আর ঢাকা-চট্টগ্রাম বা বিদেশ থেকে আসা সংবাদকর্মী। তুলনামূলকভাবে পর্যটক নেই বললে চলে।
তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইসর চেয়ারম্যান ও হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এম এন করিম জানান, ভাগ্যটা খারাপ যাচ্ছে। আমাদের হোটেলগুলোর ইনভেস্টমেন্টটা বেশি। ২০১২ সালে রামু ট্রাজেডির পর পর্যটন ব্যবসায় মন্দা চলে এসেছিল। বকেয়া পড়েছিল লোনের কিস্তি পরিশোধেও। কিন্তু পর্যটনবান্ধব প্রধানমন্ত্রী সে পরিস্থিতি কাটিয়ে তুলে রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল রাখায় গত কয়েক বছর ব্যবসাটা মোটামোটি ভালো যাচ্ছিল। কিন্তু এবারের পর্যটন মৌসুমটা গিলে খাচ্ছে রোহিঙ্গা সঙ্কট। মৌসুমের দুই মাস অতিবাহিত হলেও লক্ষ্যমাত্রার এক তৃতীয়াংশও ব্যবসা হচ্ছে না। এ কারণে চরম বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে। ঠিকমতো বেতন-ভাতা ও লোনের কিস্তি পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে। একই পরিস্থিতি অন্যসব হোটেল-মোটেলগুলোতেও।
তবে, পর্যটক না আসার পেছনে ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক যোগাযোগকেও দুষলেন দিগন্ত ট্যুরিজমের পরিচালক ইয়ার মুহাম্মদ। তার মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার মহাসড়কের অনেক জায়গা এখনও ভঙ্গুর। তাই ৫ থেকে ১২ ঘণ্টা বাস যোগাযোগে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর বিমান ভাড়াটাও অতিরিক্ত। তাই এখানে বেড়াতে ঢাকার বাইরের যে কোনো ব্যক্তির কম করে হলেও ২০ হাজার টাকা বাজেট রাখতে হয়। এ টাকায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের দার্জিলিংসহ অন্যান্য এলাকায় দিব্যি ঘুরে আসা যায়। তাই আগের ছেয়ে কক্সবাজার ভ্রমণের সংখ্যা অনেকাংশে কমছে।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন কক্সবাজারের (টুয়াক) সাবেক সভাপতি রেজাউল করিমের মতে, কক্সবাজারের পর্যটনকে আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ করে সেন্টমার্টিন। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি দেখতে ভ্রমণ পিপাসুদের একটি আগ্রহ থাকে। তাই কক্সবাজার আসা পর্যটকরা সেখানে একটা রাত কাটানো বা দিনে দিনে ঘুরে আসতে পরিকল্পনায় রাখেন। পর্যটন মৌসুম শুরুর প্রথম দিন থেকেই এখানে যাতায়ত শুরু হয়। সেভাবেই নৌ-রুটে চলাচলকারী জাহাজের দুটি ঘাটে এসে নোঙর করেছে অাগস্টের শেষ সপ্তায়। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে প্রশাসন জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়নি। ফলে স্থমিত হয়ে আসে পর্যটন ব্যবসা।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহেদ হোসেন ছিদ্দীকি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে অনেক কিছুই পিছিয়ে গেছে। সেন্টমার্টিন নৌরুটে জাহাজ চলাচলের ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডান্ট্রিজ ও সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, বিশ্বব্যাপী কক্সবাজারের পর্যটনকে প্রমোট করতে সাত সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা লগো উন্মোচনের দিন ধার্য করা ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট এটি রদ করে দেয়।
এছাড়া ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন সব হোটেল-মোটেল ও পর্যটন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বর্ণাঢ্য র্যালিসহ দিনব্যাপী নানা আয়োজন করত। যা বিশ্ববাসী দেখে কক্সবাজারে আসতে প্রলুব্ধ হন। কিন্তু এবারে সেই অনুষ্ঠানমালাও রোহিঙ্গা সঙ্কটে হারিয়ে যায়। এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কারণ কক্সবাজারে পর্যটন সেবায় লাখো পরিবারের আহার সংস্থান জড়িত।
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার রায়হান কাজেমী বলেন, বিগত বছরের তুলনায় চলতি পর্যটন মৌসুমে পর্যটক সমাগম কম। এরপরও সৈকতসহ পুরো পর্যটন এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জোরদার রয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা টেকনাফ, ইনানী, হিমছড়ি ও কক্সাবাজার সমুদ্র সৈকতে নানাভাবে দায়িত্ব পালন করছে। রয়েছে স্পেশাল টিমও। এছাড়া ওয়াচ টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষণসহ ২৪ ঘণ্টা চালু রয়েছে হটলাইন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশসাক মো. আলী হোসেন বলেন, পর্যটক সেবায় আমরা সব সময় প্রস্তুত। কিন্তু চলতি রোহিঙ্গা সঙ্কট পর্যটন ব্যবসায় একটু ধীর গতি এনেছে। নানা কারণে পর্যটন সংশ্লিষ্ট অনেক সেবার অনুমতি বিবেচনাধীন। একসঙ্গে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে মানব্কি আশ্রয় দিতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কার্যক্রমে স্থবিরতা এসেছে। আশা করছি এ সঙ্কট দ্রুত কেটে যাবে। জাগো নিউজ