‘হ্যালো, আমি এয়ারপোর্টের ভেতর থেকে বলছি। আপনার ছেলে প্রবলেমে পড়েছে। ফ্লাইটে উঠতে পারছে না। কাগজপত্র নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। সমাধান করতে হলে টাকা লাগবে। দ্রুত এই নম্বরে বিকাশ করে ৩০ হাজার টাকা পাঠান।’
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশগামী ছেলেকে বিদায় জানাতে আসা রহমত আলীর ফোনে এভাবেই টাকা চাওয়া হয়। রাজবাড়ী জেলার রহমত আলীর ছেলে শাওন কাজ করতে দুবাই যাচ্ছিলেন। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে ছেলেকে বিদেশে পাঠাচ্ছিলেন তিনি।
শেষ মুহূর্তে সংকটের খবরে বিচলিত হয়ে ওঠেন রহমত আলী। ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তির কাছে ছেলের সঙ্গে কথা বলার আকুতি জানান তিনি। তখন অপর প্রান্ত থেকে কান্নাজড়িত মৃদুকণ্ঠে একজন বলে, ‘বাবা প্রবলেম হয়ে গেছে। আমার যাওয়া হবে না। শিগগির টাকা পাঠাও।’ রহমত ছেলের বিপদ শুনে দ্রুত এক আত্মীয়র মাধ্যমে বিকাশের নির্দিষ্ট নম্বরে টাকা পাঠান। তখন থেকে কল দেওয়া সেই নম্বর এবং শাওনের নম্বর বন্ধ।
উৎকণ্ঠায় সময় কাটে স্বজনদের। ছয় ঘণ্টা পরে শাওন দুবাই থেকে তাঁর বাবাকে ফোন করে নিরাপদে পৌঁছানোর খবর জানান। তখন রহমত আলী বিমানবন্দরে কী ‘প্রবলেম’ হয়েছিল এবং শাওন টাকা পেয়েছিলেন কি না জানতে চান। কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন শাওন। তিনি বলেন, কোনো সমস্যাই হয়নি এবং তিনি টাকাও চাননি।
এক বছর আগের এ ঘটনায় রহতম আলী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পারে তারা একটি প্রতারণার শিকার। তবে এ প্রতারণা কে, কিভাবে করল তা বুঝতে পারেনি তারা। স্থানীয় থানায় অবশ্য একটি সাধারণ ডায়েরি করে রাখে।
গত তিন বছরে রহমত আলীর মতো এক হাজারেরও বেশি বিদেশগামী যাত্রীর স্বজনদের কাছে বিমানবন্দরের ভেতর থেকে ‘প্রবলেমের’ কথা জানানো হয় ফোনে। এরপর বিকাশ নম্বর দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। ভুক্তভোগীদের মধ্যে অনেকেই বিমানবন্দরের পুলিশ, সিভিল এভিয়েশন, ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ বিভিন্ন স্থানে মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ করেছে। তবে প্রতারণার সূত্র খুঁজে পায়নি কেউ। শেষে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা এক মামলার তদন্তে নেমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) রহস্য ভেদ করেছে।
সিআইডি সূত্রে জানা যায়, বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষী জাবেদ (৪০) এই অভিনব প্রতারকচক্রের হোতা। তিনি বিদেশগামী যাত্রীদের তথ্য ফরম পূরণ করার সময় এবং কথা বলে স্বজনদের ফোন নম্বরসহ প্রয়োজনীয় তথ্য নিতেন। ফ্লাইটে ওঠার পর বিদেশগামী যাত্রীর মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ হলেই শুরু হতো জাবেদের ‘প্রবলেম’ প্রতারণা। স্বজনদের ফোন করে সমস্যার কথা বলতেন, এমনকি কণ্ঠ নকল করে কেঁদেও স্বজনদের তা বিশ্বাস করাতেন জাবেদ। সিআইডি কর্মকর্তাদের ধারণা, জাবেদ এ রকম প্রতারণা করে গত তিন বছরে কমপক্ষে ছয় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত বুধবার গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে বিমানবন্দরের কনকোর্স হলের বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান এমকে ট্রেডার্সের কর্মী জাবেদ এবং দুই বিকাশ এজেন্টকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য দুজন হলেন মেহেদী হাসান (৪৫) ও ইউসুফ (৫০)। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার মহানগর হাকিম আদালত তাঁদের দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে ও তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলছে। গত তিন বছরে এক হাজারেরও বেশি যাত্রীর স্বজনদের ফোন নম্বরে একই কায়দায় সমস্যার কথা বলে প্রতারণা করেন জাবেদ। গত তিন মাসেই ৩৯৩টি ফোন নম্বরে টাকা চান তিনি। তাঁর টার্গেটের মধ্যে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ সফল হয়েছে বলেও তথ্য মিলেছে। এতে কমপক্ষে ছয় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন জাবেদ ও তাঁর সহযোগীরা। বিমানবন্দরের সামান্য নিরাপত্তাকর্মী হলেও নিজ এলাকায় তিনি ‘বড় অফিসার’ ও ‘দানবীর’ হিসেবে পরিচিত। গাজীপুরের তরফপাড়া এলাকায় মার্কেটও করেছেন জাবেদ।
এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির বিশেষ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিদেশগামী যাত্রী বা বিমানবন্দরে এগিয়ে দিতে আসা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কৌশলে সখ্য গড়ে ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করে জাবেদ। আবার তথ্য ফরম পূরণ করার সময়ও নম্বর পেত। এরপর যাত্রী বিমানে ওঠার পরপরই স্বজনদের ফোন করে সমস্যার কথা বলে এভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এরা দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছিল। জাবেদ এক হাজারের বেশি যাত্রীর পরিবারের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছে। নির্ধারিত বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে সে টাকা নিত। এসব বিকাশ এজেন্ট এই চক্রেরই সদস্য। ’
তদন্তের ব্যাপারে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনহাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ ধরনের প্রতারণা দেখে আমরাই বিস্মিত। জাবেদ ২০১২ সালে এমকে ট্রেডার্সের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ নেয়। এর এক বছর পর ২০১৩ থেকেই সে প্রতারণা শুরু করে। সে মূলত কম শিক্ষিত এবং মধ্যপ্রচ্যে যাওয়া শ্রমিকদের টার্গেট করত। তাদের স্বজনরা স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যাবে ভেবে ঋণ করেও জাবেদকে টাকা পাঠায়।’ তিনি আরো বলেন, ভুক্তভোগী কেউ কেউ বিমানবন্দরে মৌখিকভাবে অভিযোগ করলেও মামলা করেনি। কেউ কেউ জিডি করেছে। গত তিন মাসেই ৩৯৩ জনকে ফোন করে টাকা চাওয়ার তথ্য পেয়েছে সিআইডি। এর মধ্যে শতাধিক বিদেশগামীর স্বজনরা টাকা দিয়েছে।
মিনহাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, জাবেদ গত তিন বছরে কমপক্ষে ছয় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার) জাবেদ ও তার সহযোগীদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করি। আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে আরো তথ্য জানা যাবে। ’
সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, গাজীপুরের তরফপাড়া এলাকার মৃত আব্দুল জব্বারের ছেলে জাবেদ এলাকায় বিমানবন্দরের বড় কর্মকর্তা বলেই পরিচিত। তাঁর বাড়ি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। বাড়ির পাশে দিয়াবাড়ী ক্লাবের পাশে মার্কেটও আছে জাবেদের। তাঁর আরো সম্পদের খোঁজে নেমেছে সিআইডি।
জানা গেছে, মোহাম্মদপুর থানায় গত ১৮ জুলাই দায়ের করা একটি মামলার সূত্রে সিআইডি শনাক্ত করে জাবেদকে। ওই ঘটনার ভুক্তভোগী আবুল বাশার জানান, গত ১৭ মার্চ তাঁর ছেলে বাহরাইনে কাজ করতে যান। ওই দিন ছেলেকে বিমানে তুলতে গিয়ে জাবেদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ছেলেকে বিদায় দেওয়ার পর এক ব্যক্তি বাশারকে ফোন করে বলে, বিমানবন্দরে কিছু সমস্যায় পড়েছেন তাঁর ছেলে, তাই কিছু টাকা লাগবে। আগপিছ না ভেবেই বাশার ৩৬ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন ওই ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া বিকাশ নম্বরে। পরে ছেলের সঙ্গে কথা বলে তিনি প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন। একপর্যায়ে ঘটনাটি তদন্তের আশায় মামলা করেন।
সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, তথ্য-প্রযুক্তি বিশ্লেষণ ও জিজ্ঞাসাবাদ করে জাবেদের মাধ্যমে প্রতারিত ব্যক্তিদের শনাক্ত করছেন তাঁরা।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ