লন্ডনের বহুল প্রচারিত দৈনিক ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড গত ১৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার একটি আকর্ষণীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে ২০১৭ সালের লন্ডনের ১ডজন হিরো নারী ও পুরুষের তালিকা পেশ করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হল, এই ১২ জনের ৩ জনই মুসলিম পরিবারের গর্বিত সন্তান।
হিরোদের এই তালিকাটি প্রণয়নে ২০১৭ সালে লন্ডনে ঘটে যাওয়া একাধিক সন্ত্রাসী হামলা ও দুর্ঘটনার সময় বা পরে যারা বিভিন্নভাবে বিরল ভূমিকা রেখেছেন- তাদের প্রতি লক্ষ রাখা হয়েছে। যেমন- ২২ মার্চ ওয়েস্টমিনিস্টারে হামলা, ৩ জুন লন্ডন ব্রিজে হামলা, ১৪ জুন গ্রেনফিল টাওয়ারে আগুন লাগার ঘটনা, ১৯ জুন ফিন্সব্যারি পার্ক মসজিদের পাশে মুসল্লিদের ওপর হামলা প্রভৃতি।
অনুসন্ধানী এই রিপোর্টের ভূমিকায় ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক মিস্টার জর্জ ওসবোর্ন বলেন, তারাই হলেন আমাদের এই আধুনিক নগরীর মান ও মর্যাদার ধারক, বাহক ও রক্ষক। তাদের কেউই এর আগে সমাজে এমন পরিচিত বা প্রসিদ্ধ ছিলেন, বরং তারা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি যে, এই বছর লন্ডনের হিরোদের তালিকায় তাদেরও স্থান হবে!
লন্ডন নগরীর (প্রথম মুসলিম) মেয়র সাদিক খান বলেন, আমি গর্বিত। সত্যি তারা হলেন আমাদের সমাজের হিরো। আমাদের রক্ষা ও নিরাপত্তার স্বার্থে তারা নিজেদের ঝুঁকি ও বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। তাদের এমন বীরত্ব, সাহসিকতা ও প্রতিরোধশক্তি আমাদের জন্য বিষণ দুঃখের সময়ও প্রত্যাশার বাতিঘরে পরিণত হয়েছিল। লন্ডন নগরীর মেয়র হিসেবে আমি তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। তাদের এরকম বীরত্বগাথা ইতিহাস আমাদের লন্ডন সিটির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণে সর্বদা আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে। সঙ্গতকারণে এখানে সকলের কথা না বলে মুসলিম তিন হিরোর সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত তুলে ধরা হলো:
১) ইমাম মুহাম্মাদ মাহমুদ। তিনি লন্ডনের ফিন্সব্যারি পার্ক মসজিদের ইমাম ও খতিব। মূলত তিনি মিসরীয় বংশোদ্ভূত। ১৪ জুন তারাবি শেষে মুসল্লিগণ যখন ঘরে ফিরছিলেন, ঠিক তখনি একজন ভেন ড্রাইভার ইচ্ছাকৃত মুসল্লিদের ওপর গাড়ি তুলে দেয়। এতে বেশ কয়েকজন আহত এবং একজন বাংলাদেশি মুসল্লি নিহত হয়েছিলেন। ওইসময় বিক্ষুব্ধ জনতা সন্ত্রাসী ড্রাইভারের ওপর হাত তুলতে গেলে মসজিদের ইমাম তাদের নিবৃত্ত করেন এবং ইমার্জেন্সি পুলিশ কল করে ওই সন্ত্রাসীকে আইনের হাতে তুলে দেন। বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের থামাতে তিনি বলেছিলেন, দেখুন! আমরা সবাই রোজা রাখছি। এখন রমজান মাস। আমাদের সংযত থাকতে হবে। ইংল্যান্ডের বেশ কয়েকটি দৈনিক, যেমন- দ্যা গার্ডিয়ান, ডেইলি মেইল, ডেইলি মেট্রো, ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড প্রভৃতি শায়খ মুহাম্মাদ মাহমুদকে ‘হিরো ইমাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কোনো কোনো পত্রিকায় ওইসময় তার লম্বা লম্বা সাক্ষাতকার ছাপা হয়েছিল।
২) মুয়াজ মাহমুদ। তিনি ইমাম মুহাম্মাদ মাহমুদের ছোটভাই। ওই ঘটনার সময় তিনি নিজ ঘরে গোসল করছিলেন। তাদের ঘর মসজিদের পাশেই হওয়ায় তিনি ঘটনা শুনতে পান এবং তড়িৎ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সন্ত্রাসীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করতে ভাইকে সহযোগিতা করেন।
৩) জয়ন লোকমান মিয়া। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে লন্ডনে তার জন্ম। তিনি বৃটেনের ন্যাশনাল জাকাত ফাউন্ডেশনের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা। ১৯ জুন রাতে লন্ডনের গ্রেনফিল টাওয়ারে মর্মান্তিক অগ্বিকাণ্ডের পর ঘরহারা মানুষের সাহায্যে স্থানীয় মুসলমানদের অবদান ছিল সর্ব মহলে আলোচিত ও প্রশংসিত। সেই মুহূর্তে তাদের সংস্থা বিরাট অংকের আর্থিক অনুদান পেশ করে। এ প্রসঙ্গে জয়ন মিয়া বলেন, এটা দেখার বিষয় নয় যে, আমাদের রঙ কী অথবা আমরা কোথা থেকে এসেছি। আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, এখানে যাদের সাহায্য পাওয়া দরকার তারা সেটা যথাযথভাবে পেয়েছে। বস্তুত এসব কর্মযজ্ঞ অমুসলিমদের সামনে মুসলমানদের সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছে এবং মুসলমানদের ব্যাপারে কারো কারো নেতিবাচক চিন্তার অবসান ঘটিয়েছে।
অপরাপর হিরো নারী ও পুরুষের নাম হলো : ড্যানি কোটন, সেহান হ্যাটিয়ারাচ্চি, জেমা টেইলার, এমেলি লুইস, পাট গোলবর্ন, রিচার্ড এ্যঞ্জল, ট্রেইসি পোর্টার এবং মার্ক সিমস। (তথ্যসূত্র : ১৯ জুন’১৭- এর ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড)
লেখক : আলোচক, ইকরা টিভি, লন্ডন। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ