মধ্যপ্রাচ্যের নতুন শক্তি তুরস্ক-ইরান সম্পর্ক এখন সহযোগিতার দিকে যাচ্ছে। সম্পর্কের ‘নতুন অধ্যায়’ রচনায় দেশ দু’টি অত্যন্ত আগ্রহী হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও আঞ্চলিক বিভিন্ন সঙ্কট নিরসনে তেহরান-আঙ্কারা ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করছে, যৌথ উদ্যোগে মনোযোগী হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায় রচনা করছে প্রতিবেশী দেশ দু’টি।
তুরস্ক-ইরানের সম্পর্কের নতুন মেরুকরণের প্রমাণ- তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের ইরান সফর, ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্যকে ভবিষ্যতে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা, ইরাক ও সিরিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই ও আঞ্চলিক সঙ্কট সমাধানে অভিন্ন নীতি, ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন ঠেকাতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে একতা, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সর্বাত্মক উন্নয়ন ও অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষার সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কাতারের সাথে বাণিজ্য সুবিধার লক্ষ্যে বিকল্প স্থলবাণিজ্য পথ তৈরি, সিরিয়ায় দীর্ঘমেয়াদে শান্তির জন্য সঙ্কট নিরসনে সহযোগিতা করতে একমত হওয়া, পারস্পরিক মতপার্থক্য কমিয়ে আনতে সংলাপের সদিচ্ছা, রাশিয়ার সাথেও একসাথে কাজ করতে প্রস্তুতি গ্রহণ, কাতারে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলো কর্তৃক অর্থনৈতিক অবরোধের ঘটনায় একই ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন ইত্যাদি।
ইসলামিক স্টেট-বিরোধী (আইএস) যুদ্ধ, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিস্তারের ক্ষেত্রে ইরান ও তুরস্কের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। ইরান-তুরস্ক সম্পর্কে নাটকীয় পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যেও দুই দেশকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলিতে ইরান ও রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তুরস্কও সহযোগিতা ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে চায়; ইতোমধ্যে তা প্রমাণ হয়েছে। সুন্নি মতাবলম্বী কাতার ও শিয়া মতাবলম্বী ইরানের সাথে সম্পর্ক স্থাপন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এতে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব প্রশমিত হবে। তুরস্ক ব্যবসার স্বার্থে মধ্যস্থতা করায় তিন দেশের মধ্যে ভবিষ্যতে সামরিক চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে। তুরস্ক-ইরান স্থলপথ চালুর ফলেই কাতারবিরোধী অবরোধ ব্যর্থ হয়। কাতারকে একঘরে করার চেষ্টার কঠোর নিন্দা করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, কাতারের ওপর এই অবরোধ অমানবিক এবং অনৈসলামিক। তাদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা ইসলামি মূল্যোধের বিরোধী। এটা কাতারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার শামিল।
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ইরান ও তুরস্কের সম্পর্ক এগিয়ে চলেছে। চলমান আঞ্চলিক সমস্যা ইরান ও তুরস্কের মধ্যকার সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারেনি এবং তেহরান-আঙ্কারার সম্পর্ক বাড়ানোর পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। কাতারের সাথে আরব বিশ্বের সাতটি দেশের কূটনৈতিতক সম্পর্ক ছিন্নের পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। অন্য দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের তিক্ততা থেকে তুরস্ক-ইরানের দিকে ঝুঁঁকছে কাতার। কাতারের দুর্দিনে পাশে থেকেছে তুরস্ক। সমুদ্রপথে কাতারে খাবার পাঠিয়েছে ইরান। আরব বিশ্বের এ রকম সিদ্ধান্তে কাতারের সাথে ইরান ও তুরস্কের সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়েছে। তুরস্ক, ইরান ও কাতার যদি গ্যাস নিয়ে ভিন্ন চিন্তা করে, তাহলে অনেকটাই চাপে পড়ে যাবে আরব বিশ্বের দেশগুলো। কুর্দিস্তানের সদ্য সমাপ্ত গণভোট নিয়ে নতুনভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মধপ্রাচ্য। ইরাকের স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান এলাকার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একজোট হয় ইরাক-ইরান-তুরস্ক। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা খামেনি বলেছেন, ‘কিছু বিদেশী শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের মতো আরেকটি অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আমেরিকা ও ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যেই সম্প্রতি ইরাকের কুর্দিস্তানে বিচ্ছিন্নতাকামী গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
নানা দিক থেকেই ইরান-তুরস্ক-রাশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। ইরান-রাশিয়ার কৌশলগত সহযোগিতায় তুরস্ক যুক্ত হওয়ায় আমেরিকাও কিছুটা চিন্তিত। যেকোনো বিচারেই ইরান-তুরস্কের একসাথে পথচলায় আন্তরিকতা ও আগ্রহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেন নাটকীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
আঞ্চলিক ইস্যু ছাড়াও বৈশ্বিক বা মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন ইস্যুতে যৌথভাবে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে আঙ্কারা-তেহরান। সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের অসামরিকীকরণ জোনে ৫০০ করে সামরিক পুলিশ মোতায়েনে সম্মত হয়েছে রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরান। আফগানিস্তানের বিষয়ে পাকিস্তানের অবস্থানকে সমর্থন করেছে চীন, ইরান ও তুরস্ক। রোহিঙ্গাদের রক্ষায় সিদ্ধান্ত জানায় ইরান-তুরস্ক-মালয়-ইন্দোনেশিয়া। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর হত্যা নির্যাতন বন্ধের বিষয়ে তুরস্ক-মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে টেলিফোনে আলাপ করেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, রোহিঙ্গাদের মতো নির্যাতিত মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সাথে টেলিফোনে আলাপকালে রোহিঙ্গা ইস্যুতে হতাশা ও উদ্বেগের কথা তুলে ধরে ইরানের
প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেন, বিশ্বের যেকোনো জায়গায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে নির্যাতন হোক না কেন, ইরান তা সহ্য করবে না।
এ দিকে ইরান-তুরস্কের ঘনিষ্ঠতাকে উদ্বিগ্ন ইসরাইল ভালো চোখে দেখছে না। তুরস্কের সাথে ইরানের সম্পর্ক উন্নয়নে তেলাবিব যথেষ্ট অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে। ইরান এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারকে আরো শক্তিশালী করতে চাচ্ছে এবং হিজবুল্লাহ এবং লেবাননকে সহযোগিতা করতে ইরাক ও সিরিয়ার সাথে স্থলযোগাযোগ স্থাপন করতে চাচ্ছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে যদি ইরান সামরিক সম্পর্ক গভীর করতে সফল হয়, যার শীর্ষে রয়েছে আঙ্কারা; তাহলে তা ইসরাইলের জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ের হুমকি হবে। সমরশক্তিতে প্রভাবশালী ইরান-তুরস্ক রাশিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। তুরস্ক সরকার পাশ্চাত্যঘেঁষা নীতি থেকে সরে এসেছে। নয়াদিগন্ত