ঘটনাটি ঠিক যেন রহস্য ঘেরা মাসুদ রানা চরিত্রের মত। গোয়েন্দাধর্মী উপন্যাস মাসুদ রানা সিরিজের নায়ক মাসুদ রানার হৃৎপিণ্ডে গিয়ে বিঁধে একটা বুলেট। সোজা হৃৎপিণ্ডে আঘাত হানার পরেও সে বেঁচে যায়! কারণ বুলেটটি তার হৃৎপিণ্ডের ইন্টারভেন্ট্রিকুলার সেপটামে বিঁধে ছিল, ফলে অতিরিক্ত কোনো ব্লিডিং (রক্ষক্ষরণ) না হওয়ায় সে বেঁচে গিয়েছিল।
উপন্যাসের এই অসম্ভব ঘটনা এবার বাস্তবে ঘটছে। গত ২৪ অক্টোবর তেমনি এক মাসুদ রানা চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দুপুর দেড়টার একটু পরে হুরমুর করে সে একটা ট্রলির ওপর শুয়ে ঢুকে পরে ঢাকা মেডিক্যালের ক্যাজুয়ালটিতে।
বাস্তবের এই মাসুদ রানা পেশায় একজন কন্সট্রাকশন ওয়ার্কার। তার নাম মাহমুদুল। তার সঙ্গে এসেছে একগাদা লোক। ৪ ফুট লম্বা, দেড় ইঞ্চি ব্যাসের একটা ৬ সুতার রড তার বুকের মাঝ দিয়ে ঢুকে পিঠের ডান দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। কিন্তু সে তখনো শ্বাস নিচ্ছে, দিব্যি কথা বলে যাচ্ছে!
জানা গেছে, মিরপুরের একটা কন্সট্রাকশন সাইটে দোতালা থেকে সরাসরি খোলা রডের ওপর পরে গেলে আড়াআড়িভাবে তার বুকের ডান পাশ থেকে বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ভয়ঙ্কর ও মারাত্মক অবস্থায় তার সহকর্মীরা কাপা হাতে রড কেটে তাকে রডসহ নিয়ে এসেছিল হাসপাতালে।
ডা. আল মোনতাছির বিল্লাহ নামে একজন চিকিৎসক এই ঘটনা শেয়ার করেছেন তার ফেসবুক ওয়ালে। অপারেশনের পূর্ব মুহূর্তের বিবরণ দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বাইরে থেকে যতটুকু এক্সেস করা হয় তাতে দেখা যায় যিফিস্টার্নামের বাম দিক থেকে আড়াআড়িভাবে ডানে ওপরের দিকে ঢুকে পিছনে ৮ম রিব ভেঙে বের হয়ে গেছে, এবং ঢোকার সময় পড়নের গেঞ্জি ভিতরে নিয়ে গেছে।
সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পুরো টিমের ইফোর্ট তার ওপর গিয়ে পরে। সব ধরনের প্রটোকল-গাইডলাইন মেনে তাকে ওটির জন্য রেডি করতে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠে। সারপ্রাইজিংলি ভাইটালস সব নরমাল, তার মানে কোনো মেজর ইন্টারনাল ব্লিডিং নাই অথবা রডের প্রেশার ইফেক্টের কারনে বন্ধ আছে।
পরে কাপড় সরাতে গিয়ে আমাদের ভুল ভাঙে, যে রড পিছন থেকে ঢুকে সামনে দিয়ে বের হয়েছে। হতে পারে লেফট লোব লিভার ইনজুরি, হার্ট ইনজুরি, এওর্টা, ভেনাক্যাভা, ডায়াফ্রাম, স্টমাক, ইসোফেগাস, লাংস ইনজুরি। অতি দ্রুত মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে পারে অত্যাধিক ব্লিডিং, নিউমো/হিমো থোরাক্স, এমবোলিজম ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সে দিব্যি শ্বাস নিচ্ছে, ভাইটালস ভালো, অনগোয়িং সিভিয়ার কোন ব্লিডিং ছিল না।’
তিনি লিখেছেন, রোগীকে খুব তাড়াতাড়ি ক্যাজুয়াল্টি ওটি (সিওটি) তে নেওয়া হয়। খুব যত্নের সাথে ওটি টেবিলে ট্রান্সফার করার পর রড সহ অপারেটিভ ফিল্ড ওয়াশ দেওয়া হয়। মাহামুদ ভাই (অপর চিকিৎসক) রাইট থোরাকোটমি ইনসিশন দিয়ে শুরু করলেন। এনেস্থেশিয়ায় ছিলেন তুষার ভাই। আমি আর মাহাবুব ভাই এসিস্টে।
এন্ট্রি এক্সিট ওউন্ডে ইনসিশন বাড়ানোর পরও যখন বিপি ঠিক ছিল তখন আমরা একটু সাহস পেলাম যে এবার রড বের করা যায়। মাহামুদ ভাই দুই ওউন্ডে হাত দিয়ে রডের ওপর প্রেসার রিলিজ করলে আমি আস্তে আস্তে রডটা টেনে বের করলাম। যখন পুরোটা বের হল তখন সবার মাথায় চিন্তা যে এই বোধহয় কোন থ্রোম্বাস সরে গিয়ে ব্লিডিং শুরু হয়। আল্লাহর রহমতে তেমন কিছু হয়নি। তখন সুযোগ মিললো ভিতরে নজর দেবার।
রাইট লাংস লোয়ার লোব পুরো ল্যাসারেটেড (ওপেন নিউমোথোরাক্সের কারনে অক্সিজেন স্যাচুরেশনে কোন প্রব্লেম হয়নি)। ক্লট সরিয়ে দেখলাম পেরিকার্ডিয়াল ছিড়ে গেছে, তার ফাক দিয়ে হার্ট বিট করছে। হার্টের বা ডায়াফ্রামের কিছুই হয়নি। এই দুইটার মাঝখান দিয়ে রড ঢুকে লাংস রিব ভেদ করে রডটা বের হয়ে গেছে। ওয়াশ দিতে দিতে বিটিং হার্টের ওপর হাত রাখলাম। তখন যে ফিলিংসটা হল সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। ১২ বছরের মেডিকেল জীবনে প্রথমবারের মত মনে হল- ‘ম্যান, আই ডিড সামথিং রিয়েলি কুল’।
থোরাসিক সার্জনদের কাছে এগুলো ডালভাত, কিন্তু অন্য যেকোন ডাক্তারের লাইফে সে মানুষের জীবন্ত হৃৎপিন্ড হাত দিয়ে ধরেছে এটা আল্ট্রা রেয়ার ঘটনা। যাই হোক এরপর লাংস রিপেয়ার করে ড্রেন টিউব দিয়ে ক্লোজ করা হল।
তিনি জানান, এখন পর্যন্ত রোগী ভালো। কোনো অসুবিধা নেই। তবে ভয়টা ইনফেকশন নিয়ে। রডটায় যে পরিমাণ ময়লা ছিল, সেপসিস এবং এমপায়েমা হবার চান্স আছে অনেক। ওটিতে বেশ কিছু ভুল ছিল। অবশ্য ভুলগুলো পেছনে কারণও ছিল। তারা পেছনটা যতটা এক্সপ্লোর করেছেন সামনেরটা ততটা করেননি। তাদের মাথায় ছিল ড্যামাজ কন্ট্রোল সার্জারি করার, পরে রড বের হয়ে যাবার আনন্দে আর কোনো ব্লিডিং না থাকার উত্তেজনায় পটাপট ক্লোজ করে বের হয়ে আসেন তারা।
ডা. আল মোনতাছির বিল্লাহ সবার উদ্দেশ্যে বলেন, তার জন্য কোনো আর্থিক সাহায্য লাগবে না, ঠিকাদার নিজ গরজেই সব খরচ দিচ্ছে। তার জন্য দোয়া করলেই চলবে। তাকে ওপারেশন টেবিলে তোলার ঠিক আগ মুহূর্তে তার যে চেহারা হয়েছিল তা অনেকদিন ভুলার নয়। সে জানে সে কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাচ্ছে, সে কাদছে নীরবে এক অনাত্মীয় পরিবেশে। আল্লাহ যেন তার চোখের পানিকে হাসিতে পরিণত করে দেন। ২৪লাইভনিউজপেপার