কোকা-কোলা, পেপসি, সেভেন-আপ, স্প্রাইট। যেকোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়া শেষে এসব সফট ড্রিংকস অর্ডার করেন অনেকেই। তবে ইচ্ছামতো এগুলোর দাম ধরে গ্রাহকদের চাহিদার সুযোগ নিয়ে ‘গলা কাটছে’ দেশের রেস্টুরেন্টগুলো। ৬ থেকে ১০ টাকা খরচের ২৫০ মিলিলিটারের (এমএল) সফট ড্রিংকস/পানীয় তারা ৭০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি করছেন।
সরেজমিনে রাজধানীর বেশ কয়েকটি দেশি ও আন্তর্জাতিক চেইন রেস্টুরেন্টে গিয়ে এ চিত্র দেখা গেছে। সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার চেইন ‘নান্দুস’র গুলশান শাখায় গিয়ে মেন্যুতে (খাবার ও মূল্য তালিকা) ২৫০ এমএল সফট ড্রিংকসের দাম ৯৯ টাকা নিতে দেখা যায়। কিচেনের সামনের টেবিলে বসে এক গ্লাস ফান্টা অর্ডার করতেই চোখে পড়ল ফান্টার দেড় লিটার বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে পরিবেশনের দৃশ্য। বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে নেয়া ফান্টার প্রতি গ্লাসের দাম পড়বে সর্বোচ্চ ১০ টাকা। অথচ ভোজনবিলাসীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে একই সফট ড্রিংকসের দাম নিচ্ছে ৯৯ টাকা। অথচ তারাই বাংলাদেশি মাত্র ১১৫ টাকায় যত খুশি তত (আনলিমিটেড) ড্রিংকস দিচ্ছে মালয়েশিয়ায়।
ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনে পানি ও পানীয়ের বোতলে এমআরপি’র (সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য) চেয়ে বেশি দাম আদায় করলে শাস্তি ও জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ধরনের অপরাধের অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে।
নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৪ টাকা বেশি নিয়ে ১০ হাজার টাকা জরিমানা গুনেছেন এমনও নজির রয়েছে। আইন ফাঁকি দিতে বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে গ্রাহকদের ড্রিংকস পরিবেশন করছে ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টগুলো। বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে দেয়ার পাশাপাশি ‘ফাউন্টেন মেশিন’ দিয়ে সফট ড্রিংকস বিক্রি করে কয়েকগুণ বেশি দাম নিচ্ছে তারা।
‘ফাউন্টেন মেশিন’ শব্দটির সঙ্গে অনেকে পরিচিত না হলেও রেস্টুরেন্টে মেশিনটি দেখেননি এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। কয়েকটি ছোট ছোট ট্যাংকি ও কল থাকে মেশিনটিতে। কলগুলোর উপরে পেপসি, কোকা-কোলা ইত্যাদির স্টিকার দেয়া থাকে। মেশিনটিতে চাপ দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্ডার করা ড্রিংকসটি ওয়ান টাইম ইউজেবল গ্লাসে পড়ে। সফট ড্রিংকসের শুকনা কাঁচামাল ঢুকিয়ে এ ফাউন্টেইন মেশিনটি পানির লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিতে হয়।
ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে মেশিন ও কাঁচামাল সরবরাহ করে বাংলাদেশের বেভারেজ প্রতিষ্ঠানগুলো (ট্রান্সকম-পেপসি, আবদুল মোনেম-কোকা-কোলা)।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ধানমন্ডির একটি ফাস্টফুডের ম্যানেজার বলেন, ট্রান্সকম বেভারেজের (পেপসি, সেভেন-আপ, মিরিন্ডা) ফাউন্টেইন মেশিনের জন্য ৩০ হাজার টাকা ডিপোজিট জমা রাখতে হয়। সবমিলে প্রতি গ্লাসে আমাদের খরচ পড়ে ১৭ টাকা।
তবে এ ধরনের মেশিন যারা সরবরাহ করেন এমন প্রতিষ্ঠানের একজন জানান, ফাউন্টেইন মেশিনে ২৫০ এমএল ড্রিংকসের খরচ পড়ে সর্বোচ্চ পাঁচ টাকা। ওয়ান টাইম গ্লাসের দাম সর্বোচ্চ এক টাকা। কিন্তু ফাউন্টেইন মেশিনের মাধ্যমে বাংলাদেশের কেএফসিতে ২৫০ এমএল কোক বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা, পিৎজা হাটে ১২৫ টাকা এবং বার্গার কিং-এ ৭৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
২৫০ এমএল সফট ড্রিংকস ভারতের কেএফসিতে মাত্র ২৭ টাকা (২১ রুপি), থাইল্যান্ডের কেএফসিতে দেড় লিটার অর্থাৎ ছয় গ্লাস ড্রিংকস মাত্র ৯৫ টাকায় (৩৯ বাথ) পাওয়া যায়। ভারতের পিৎজা হাটে এক গ্লাস ড্রিংকস ৭৫ টাকা (৬০ রুপি), থাইল্যান্ডে প্রতি গ্লাস বাংলাদেশি ১৮ টাকায় পাওয়া যায় অথচ বাংলাদেশে এর মূল্য রাখা হচ্ছে ১২৫ টাকা। বাংলাদেশে প্রতি গ্লাস ৯৯ টাকায় ড্রিংকস বিক্রি করা নান্দুস মালয়েশিয়ায় মাত্র ১১৫ টাকায় এবং ভারতে ১৩৮ টাকায় আনলিমিটেড পানীয় দিচ্ছে।
সম্প্রতি দেশে ফিরে মালয়েশিয়ার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আয়ান রহমান বলেন, ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো এশিয়ার দেশগুলোতে যেকোনো কম্বো মিলের (খাবারের প্যাকেজ) সঙ্গে ৫০ টাকা অতিরিক্ত দিলেই গ্লাসে ৭৫০ এমএল সফট ড্রিংকস দেয়া হয়। তাদের সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণ দাম আদায়ের জন্য নীতিমালা ঠিক করে দিয়েছে, তারা তা মানেন। অথচ বাংলাদেশে মূল্য নির্ধারণের নীতিমালা থাকলেও কেউই তা মানছেন না। কেউ এগুলো নজরদারিও করছেন না।
ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চেইন হোটেলগুলো বেভারেজ বিক্রিতে কয়েকগুণ বেশি দাম নিয়ে পকেট কাটছে গ্রাহকের। সরেজমিনে রাজধানীর র্যাডিসন ব্লু হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, ২৫০ এমএল পানীয়ের (কোক-স্প্রাইট) দাম ২৫০ টাকা, ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১০ শতাংশ সার্ভিস চার্জসহ মোট দাম পড়ে ৩১৩ টাকা। এছাড়া আমদানি করা (ইমপোর্টেড) কোকা-কোলা ক্যানের দাম ৪৬৩ টাকা।
রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের লবি লাউঞ্জে প্রতি গ্লাস ডায়েট কোক এবং ইমপোর্টেড কোকের ক্যান ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দেশের প্রতিষ্ঠানসমূহের মূল্য তালিকা নির্ধারণ ও নজরদারির দায়িত্ব বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান সিনিয়র সচিব মুশফেকা ইকফাৎ। তার সঙ্গে কথা বলতে ফোন দেয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) শাহাদাত হোসেন বলেন, বোতল থেকে গ্লাসে সফট ড্রিংক ঢেলে দেয়ার বিষয়টি আমিও দেখেছি। প্রয়োজনে তারা এক গ্লাস ড্রিংকসের সঙ্গে দোকানের এসি, একটি টিস্যু বা আনুষঙ্গিক খরচের জন্য সার্ভিস চার্জ নিতে পারেন। তবে তারা কোনোভাবেই অতিরিক্ত দাম নিতে পারেন না। ভোক্তাদের সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য নির্ধারণে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের কাজ করার কথা। সৌজন্যে: জাগো নিউজ