অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষক ও বিজ্ঞানী মুহম্মদ জে এ সিদ্দিকী। যেসব তরুণ উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় যেতে চান, তাঁদের উদ্দেশে লিখেছেন তিনি
পাঁচ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বৃত্তি (স্কলারশিপ) কমিটিতে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমার কাজ ছিল আবেদনকারী আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করা| সেই তালিকা থেকেই অনেক যাচাই-বাছাই করে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা হতো। চুলচেরা বিশ্লেষণ হতো। সেখান থেকে বাছাই করা নির্দিষ্টসংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হতো। তবে বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের সিভি, ট্রান্সক্রিপ্ট, রিকমেন্ডেশন লেটার—এগুলো পড়ে, দেখে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। তা ছাড়া আমার নিজের গবেষণাগারেও কিছু বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী কাজ করছে। এই অভিজ্ঞতাগুলোর কথাই আপনাদের বলব।
পিএইচডির জন্য যাঁরা আবেদন করতে চান: অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডির ভর্তি এবং বৃত্তির জন্য যাঁরা আবেদন করেন, তাঁদের আবেদনপত্র দেখে প্রথমেই তাঁরা কোন দেশের বাসিন্দা, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা অস্ট্রেলীয় শিক্ষার সমমানের কি না, তা মূল্যায়ন করা হয়। এরপর যে বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় তা হলো স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ভালো ফলাফল। দুটিতেই সিজিপিএ-৩.৫-এর বেশি থাকলে ভালো।
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে থিসিস অবশ্যই থাকতে হবে| সেই থিসিস বা অভিসন্দর্ভ আবার নামমাত্র হলে হবে না| দুটি থিসিসই কমপক্ষে ৭০ থেকে ১০০ পৃষ্ঠার হতে হবে (১০ থেকে ১৪ হাজার শব্দের মধ্যে)| থিসিসগুলো মানসম্পন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ পেলে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়।
ইদানীং একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি। বাংলাদেশ থেকে অনেক ছেলেমেয়ে একেবারেই নামসর্বস্ব আন্তর্জাতিক জার্নালে থিসিস প্রকাশ করছে। আইএসআই বা এসসিআই (ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিফিক ইনডেক্স বা সায়েন্স সাইটেশন ইনডেক্স)—কোনো সূচকেই অনেক সময় এই জার্নালগুলোর নাম খুঁজে পাওয়া যায় না| আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ হলো, নামমাত্র জার্নালে এত বেশিসংখ্যক লেখা না ছাপিয়ে ভালো মানের জার্নালে দু-একটি থিসিস প্রকাশই বুদ্ধিমানের কাজ| ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর (ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর হলো জার্নালের মান বোঝার জন্য স্বীকৃত একটি আন্তর্জাতিক পদ্ধতি) তিনের বেশি, সেসব জার্নালে থিসিস প্রকাশিত হলে খুবই ভালো। এতে শিক্ষার্থীর কাজ ও গবেষণা সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা তৈরি হয়|
যাঁদের ভালো প্রকাশনার সুযোগ নেই, তাঁরা কী করবেন? আমার পরামর্শ হলো, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান বা এ রকম কোনো একটি দেশ থেকে স্নাতকোত্তর করে ফেলতে পারেন| এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভালো প্রকাশনা করে ফেলতে পারবেন| আমি নিশ্চিত, এসব দেশের ভালো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকলে অস্ট্রেলিয়ার যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির জন্য বৃত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে|
আইইএলটিএস স্কোর: অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি ও বৃত্তির আরেকটি প্রধান শর্ত হলো আইইএলটিএস স্কোর| প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই একটা ন্যূনতম আইইএলটিএস স্কোর (৬-এর কম নয়) চায়। যার আইইএলটিএস স্কোর যত ভালো তাকে তত বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়|
এখানেই কিন্তু শেষ নয়। যেহেতু যেকোনো বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ, থিসিস বা প্রতিবেদন ইংরেজিতে লিখতে হয়, তাই এই ভাষাটিতে ভালো দখল থাকলে পিএইচডি বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রির কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। আমি যত দূর জানি, যখন স্কাইপে ইন্টারভিউ নেওয়া হয়, তখন ইংরেজিতে কথা বলা ও লেখার দক্ষতাকে খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়।
রেফারেন্স ভালো হোক: সিভি তৈরি ও ‘রেফারেন্স লেটার’ নিয়ে কয়েকটি কথা বলে শেষ করব। আমার মনে হয় বেশির ভাগ বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী সিভি তৈরিতে খুব অপেশাদার ও কাঁচা। পিএইচডি করতে আসা একজন শিক্ষার্থীর সিভি খুব তথ্যসমৃদ্ধ হতে হয়| যেই ল্যাবে আবেদন করবে, সেই ল্যাবের সঙ্গে তাঁর বর্তমান ও নিকট ভবিষ্যতে পরিকল্পিত কাজের মিল আছে কি না, থাকলেও কীভাবে আছে, সিভিতে এ বিষয়টা পরিষ্কার করে দিতে পারলে বিষয়টি সুপারভাইজারের নজরে আসবে। অভিজ্ঞতার কথা লিখতে হয় খুব মার্জিতভাবে| অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেউ কেউ এমন সব অভিজ্ঞতার কথা লেখেন যাঁর সঙ্গে তার সিলেবাস বা পাঠ্যক্রমের কোনো সংযোগ নেই। ক্লাসে আপনার অবস্থান (যেমন ৫০ জন ছাত্রের ক্লাসে প্রথম অথবা নিজ বিভাগের ৫০০ জন ছাত্রের মধ্যে দশম), স্নাতক বা স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণি আছে কি না, কোনো পুরস্কার পেয়েছেন কি না, পাবলিকেশনের পরিপূর্ণ ‘রেফারেন্স’ ও ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বা সাইটেশন আছে কি না, কোনো সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন কি না (কী ধরনের সম্মেলন? ওয়েবসাইটের ঠিকানা থাকলে ভালো), পোস্টার উপস্থাপন বা বক্তব্য দিয়েছেন কি না, এসব পরিষ্কার করে লেখা ভালো।
অন্যদিকে আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরা যেসব রেফারেন্স লেটার পাঠান তার বেশির ভাগই খুব সাদামাটা হয়। কয়েকটি লাইন পড়েই বোঝা যায় খুব অসাবধানে ও গুরুত্বহীনভাবে এটি তৈরি করা হয়েছে| গত কয়েক বছরে আমি যেসব রেফারেন্স লেটার পেয়েছি, তা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের সুপারভাইজারদের দুটি রেফারেন্স লেটারের ধরন আমি ধরে ফেললাম। এর একটি অংশে আছে খুব কাঁচা ইংরেজিতে লেখা রেফারেন্স লেটার। এর কারণ (সম্ভবত) এই চিঠিগুলো সুপারভাইজারেরা নিজে লেখেন না। লেখে ছাত্রছাত্রীরা। শ্রদ্ধেয় সুপারভাইজারেরা শুধু নিজের প্যাডে (বা ই-মেইলে) এটি ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’ করেন| রেফারেন্স লেটারগুলোর দ্বিতীয় ধরনটি আরও ভয়াবহ—একই রকম বাক্য, একই রকম শব্দ| বোঝা যায়, সুপারভাইজাররা হয়তো রেফারেন্স লেটারের টেমপ্লেট ব্যবহার করেন| যাঁকে দেওয়া হবে তাঁর নাম পরিবর্তন করেন আর বাকি লেখা অভিন্ন থাকে| কিন্তু এখানে ছাত্রছাত্রীদের একটি বিষয় খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। তাঁদের মনে রাখতে হবে রেফারেন্স লেটার বৃত্তিপ্রাপ্তিতে (ডিসিশন মেকিংয়ে) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে| তাই রেফারেন্স লেটার হতে হবে সুন্দর ও শুদ্ধ ইংরেজিতে লেখা, ছাত্রছাত্রীদের অভিজ্ঞতার মার্জিত কিন্তু পরিপূর্ণ মুখপত্র। রেফারেন্স লেটারে পরিষ্কারভাবে বলতে হবে কোথায় ছাত্র বা ছাত্রীটি দুর্বল ও কোথায় তাঁর দক্ষতা। একই সঙ্গে রেফারেন্স লেটারেই বলতে হবে প্রস্তাবিত প্রকল্পের সঙ্গে ছাত্র বা ছাত্রীর অভিজ্ঞতা কীভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সুত্র: প্রথম আলো