Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

দক্ষিণ কোরিয়া গর্জন করছে। সিউলের রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ তরঙ্গের মতো ধাবিত হচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ গত শুক্রবার সাংবিধানিক আদালত কর্তৃক দেশটির প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হের অভিশংসন বহাল থাকায় উল্লাস প্রকাশ করছেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্টের সমর্থকেরা রাগে-ক্ষোভে আদালতকে ভর্ৎসনা করছেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রেসিডেন্টের দুই সমর্থক মারাও গেছেন।
তবে দক্ষিণ কোরিয়ার এই টালমাটাল অবস্থায় উত্তর কোরিয়ার ভাবভঙ্গি কিন্তু অলক্ষুনে। গত সোমবার তারা চারটি মধ্যম সারির ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করেছে। উত্তর কোরিয়ার বিজ্ঞপ্তি অনুসারে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো জাপানের এক মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালাতে সক্ষম। এসব থেকে কি আমরা ধরে নেব, কোরীয় উপদ্বীপ বিশৃঙ্খলায় ডুবতে যাচ্ছে?

এখানে দুটি বিষয় আলাদা রাখা দরকার? প্রথমত, দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহ থেকে বোঝা যায়, দেশটির রাজনৈতিক মহলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। শুধু রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট পার্কই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েননি, দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের ১০ শতাংশের জোগানদাতা মহিরুহ প্রতিষ্ঠান স্যামসাংয়ের কার্যত প্রধান ব্যক্তিও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। কোম্পানিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট লি জা-ইয়ঙ নিজের ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর বিচার কেবল শুরু হয়েছে।

chardike-ad

আটজন বিচারক সর্বসম্মতিক্রমে প্রেসিডেন্টকে হটানোর জন্য ভোট দিয়েছেন। দেশটির প্রধান বিচারক পার্কের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, তিনি ‘জনগণের আস্থার বরখেলাপ করে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। সংবিধান সমুন্নত রাখার জন্য এটা সহ্য করা যায় না।’ মনে রাখা দরকার, এর পুরোটাই ছিল জনগণ ও সংবিধান নিয়ে। যে দেশটির গণতন্ত্রের বয়স সবে ৩০ বছর, সেই দেশের আদালত যে প্রাতিষ্ঠানিক অবাধ্যতা দেখালেন, তা সত্যিই অসামান্য।

দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে এই প্রথম একজন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে অহিংস ও আইনি পথে সরানো হলো। কিন্তু এটাই শেষ নয়। পার্কের ভাগ্য যে স্যামসাংয়ের মহা ক্ষমতাশালী অংশীজন লির ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, তাতে ব্যাপারটা আরও রাষ্ট্র হয়েছে। টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লেচার স্কুলের অধ্যাপক সুঙ-ইয়ুন লি বলেছেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়ার নবীন ইতিহাসে এটা এক বড় ঘটনা। এটা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর মধ্য দিয়ে সরকার ও বড় ব্যবসায়ী মহলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠল। সমস্যাটা খুবই গভীর।’ এই কেলেঙ্কারিতে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে। এটা মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছে, ‘বিত্তশালী ও ক্ষমতাবান মানুষেরা আইনের ঊর্ধ্বে।’ সেই বিবেচনায় ‘এই রায় পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য বড় আঘাত। এটা আইনের শাসনের জয়।’

এখন আগামী দুই মাসের মধ্যে দেশটিতে নতুন নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে সম্ভাব্য জয়ী প্রার্থী হচ্ছেন দেশটির ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান ও বিরোধী নেতা মুন জে-ইন। তিনি যেসব নীতিগত প্রস্তাব দিয়েছেন, তার মধ্যে ‘সানশাইন’ নীতিতে ফেরত যাওয়া অন্যতম, যেটা ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে বাম সরকারের প্রিয় নীতি ছিল। এই নীতি ছিল উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পুনঃসম্পর্ক স্থাপনের নীতি। তবে উত্তর কোরিয়া নিয়মিতভাবে পার্কের রক্ষণশীল সরকারের সমালোচনা করত, যারা উত্তরের সঙ্গে আলোচনায় রাজি ছিল না।

এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়াকে আপস করতে আগ্রহী মনে হচ্ছে না। সম্প্রতি কিম জং উনের সরকার দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাপারে কর্কশ মন্তব্য করেছে। আর গত সপ্তাহে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ও উনের সৎভাই নামের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় মনে হচ্ছে না, তারা সমঝোতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুং-উন লি বলেছেন, এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়া আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কার্যক্রম থেকে সরে আসবে, তেমন কারণ নেই। কারণ, শুধু এর মধ্য দিয়েই দেশটি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কাছে নিজেকে এক খেলোয়াড় হিসেবে তুলে ধরতে পারবে (এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন সরকার সানশাইন নীতি গ্রহণ করলে উত্তর কোরিয়া লাভবান হবে। কারণ, এর মধ্য দিয়ে তারা দক্ষিণের কাছ থেকে আর্থিক ও বস্তুগত সুবিধা আদায় করতে পারবে)।

এমনকি ক্ষণিকের জন্যও উত্তর কোরিয়ার সামরিক শৌর্য ও দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যেও দুই দেশের মৌলিক বিভাজন লুকিয়ে রাখার জো নেই। উত্তর কোরিয়া পৃথিবীর অল্প কটি পূর্ণাঙ্গ সমগ্রতাবাদী রাষ্ট্রের একটি, যে দেশের নেতারা দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের শাসক। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া পৃথিবীর অন্যতম গতিশীল অর্থনীতির দেশ, যারা ক্রমেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আওতা বড় করছে। আর অর্থনীতির জন্য তারা গর্ব করতেই পারে। পর্যবেক্ষকেরা প্রায়ই দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’র কথা বলে থাকেন, কিন্তু আদতে তাঁদের মধ্যে তেমন প্রতিযোগিতা নেই। কয়েক বছর ধরেই এমনটা ঘটে আসছে। যে সময় পৃথিবীতে ‘কর্তৃত্ববাদের পুনরুত্থান’ ও গণতন্ত্রের কদর্যতা নিয়ে লোকে আহাজারি করছে, তখন এ রকম সম্পর্ক প্রত্যাশা করার মতোই।

এটা ঠিক, দক্ষিণ কোরিয়ায় এখনো অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু দেশটির জনগণ এক অসাধারণ নাগরিক আন্দোলনের তোড়ে ভেসে গিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, তারা প্রথাগত কায়দায় কাজ করতে রাজি নয়। তারা পরিবর্তনের জন্য এক অসামান্য আন্দোলন শুরু করেছে, এখন যার সবচেয়ে নাটকীয় ফল পাওয়া যাচ্ছে। তাদের উত্তরের ভাইয়েরাও একই রকম প্রাতিষ্ঠানিক অবাধ্যতার স্বপ্ন দেখতে পারেন, যার অভাবে তাঁদের দেশ সময়ের মধ্যে হিমায়িত হয়ে আছে। তাঁরা এমন এক নেতার প্রতি দায়বদ্ধ, যাঁর একমাত্র ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে সহিংসতার অর্গল খুলে দেওয়া।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া।
ক্রিশ্চিয়ান ক্যারিল: ওয়াশিংটন পোস্ট–এর গ্লোবাল ওপিনিয়ন বিভাগের সম্পাদক।