রাজধানীর ব্যস্ততম চার সড়কের মোড়ে বসানো হচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরা। এসব ক্যামেরার মাধ্যমে নির্ণয় করা হবে সড়কগুলোয় চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা। এ পদ্ধতিতে গাড়ির চাপ ও সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে গ্রিন বা রেড সিগন্যাল দেখাবে ট্রাফিক পুলিশ। উন্নত দেশগুলোয় আগে থেকেই এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার প্রচলিত থাকলেও দেশে এবারই প্রথম এ পদ্ধতি অনুসরণ হতে যাচ্ছে। ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ক্যামেরাগুলো বসানোর জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮ কোটি টাকা। ঢাকা সিটি করপোরেশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
রাজধানীর মহাখালী, গুলশান-১, পল্টন ও ফুলবাড়িয়া মোড়ে পাইলট আকারে প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে ঢাকার ব্যস্ততম প্রতিটি সড়কের মোড়ই ধীরে ধীরে এ প্রকল্পের আওতায় চলে আসবে। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ১২ কোটি টাকা ঢাকা দক্ষিণ ও বাকি ২৬ কোটি উত্তর সিটি করপোরেশনের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।
জাইকার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় প্রকল্পের ৫০ শতাংশ অর্থের জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের ডিপিপি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব খাদেম বণিক বার্তাকে বলেন, উত্তর ও দক্ষিণ মিলিয়ে চারটি সড়কের মোড় আধুনিকায়নের জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরার পাশাপাশি এতে ইমেজ প্রসেসিং সিস্টেমও থাকছে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট সড়কে চলাচলকারী গাড়ির সংখ্যা সহজেই নির্ণয় করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে সড়কে গ্রিন বা রেড সিগন্যাল কতক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী হবে, তা নির্ধারণও সহজ হয়ে আসবে। মূলত নগরীর যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্যই এ প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
নতুন এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নগরীর চারটি ইন্টারসেকশনে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত (ট্রাফিক অ্যাকসিডেন্ট ডাটা) ও রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যাগত তথ্য (ট্রাফিক ভলিউম ডাটা) খুব সহজেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড করা সম্ভব হবে। চারটি সড়কেই যানবাহনের মসৃণ চলাচল নিশ্চিত করা হবে অপটিমাল কন্ট্রোল অব ট্রাফিক সিগন্যালের মাধ্যমে। এর ফলে প্রকল্প এলাকার আশপাশে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে ইন্টারসেকশনগুলোয় পুলিশ কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের পক্ষে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও তদারকি চালানোও সম্ভব হবে। এতে করে কোনো চালক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটালে তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
চালকের পক্ষেও আর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের মরদেহ ফেলে পালানোর সুযোগ থাকবে না।
রাজধানীর পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) সূত্রে জানা গেছে, শহরে সমন্বিত রোড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। এতে করে একদিকে দুর্ঘটনার হার যেমন কমবে, তেমনি সামগ্রিক ট্রাফিক ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটবে। এ লক্ষ্য থেকেই প্রাথমিকভাবে ঢাকা সিটি করপোরেশনের চার এলাকার ইন্টারসেকশনে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজও হাতে নেয়া হবে। এসবের মধ্যে রয়েছে— আইটিএস ডিভাইস ফর ট্রাফিক সিগন্যালিং সিস্টেম, সিসিটিভি ক্যামেরা ও উন্নত যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা।
এর আগে পুলিশের কাজকে সহজতর ও আরো গতিশীল করতে ১৯৯৮ সালে ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন কন্ট্রোল রুম আধুনিকায়ন’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, নগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসি ক্যামেরা বসানোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয়ভাবে অপরাধ ও ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, ট্রাফিক ডিসপ্লে বোর্ডের মাধ্যমে রাস্তার যানজট পরিস্থিতি সড়ক ব্যবহারকারীদের জানানো, পুলিশের বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল করা ও ওয়াকিটকি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। প্রকল্পটি হাতে নেয়ার ১০ বছর পর কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটির আওতায় রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ৫৯টি সংযোগ ও প্রবেশমুখে ১৫৫টি ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরাও বসানো হয়। কিন্তু পুলিশ কর্তৃপক্ষ এগুলো বুঝে না নেয়ায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্যামেরা ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশনের এবারের উদ্যোগও কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ট্রাফিক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে বড় সড়কের মোড় রয়েছে ৬২টি। এর মধ্যে মাত্র চারটিকে স্বয়ংক্রিয় করলে যানজট কমার পরিবর্তে বেড়ে যাবে। শহরের সব সড়ক মোড়ে একই সঙ্গে আইটিএস স্থাপন না করা হলে বাংলাদেশে এর কোনো সফলতা পাওয়া যাবে না। যদিও বিশ্বের বড় বড় শহরে এ পদ্ধতি কার্যকর রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, উন্নত বিশ্বে এ পদ্ধতি সফল। কারণ সেখানে গাড়ির সংখ্যা অনেক কম। তবে রাজধানী ঢাকায় যে হারে গাড়ি বাড়ছে, তাতে করে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের তুলনা করা উচিত হবে বলে আমি মনে করি না। সড়কের মোড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর যে পূর্বশর্তগুলো রয়েছে, তা আমাদের ঢাকা শহরে নেই। এর আগেও এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু জনগণ তার কোনো সুফল পায়নি। তাই নতুন করে এ উদ্যোগ আবারো নেয়া হলে অর্থের অপচয় ছাড়া আর কোনো লাভ হবে না।
এ সময় আগে নেয়া উদ্যোগ কি কারণে ব্যর্থ হয়েছিল, তা নির্ণয় না করেই সরকারের এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়া উচিত হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি। বণিক বার্তা ।