নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর — এ তিন জেলা নিয়ে বৃহত্তর নোয়াখালী।এ অঞ্চলে কৃষিই ছিল প্রধান, বলতে গেলে একমাত্র জীবিকা। তিন-চতুর্থাংশ জমিতে আউশ ও পাট আবাদ হতো না। চাষাবাদের কাজ ছিল বড়জোর ছয় মাস। বাকি ছয় মাস যেত কাজ ছাড়াই। তার পরও কৃষকই ছিলেন অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে প্রাগ্রসর শ্রেণী। বড় পরিসরে কোনো ব্যবসা বা উৎপাদন কারখানা তখনো গড়ে ওঠেনি। অল্পকিছু মহাজন থাকলেও তারা ছিলেন বহিরাগত। বিশ শতকের তিরিশের দশক পর্যন্ত এই ছিল বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের অর্থনীতি।
এমনিতেই খাদ্যঘাটতির অঞ্চল ছিল নোয়াখালী। কৃষি উৎপাদন বলতে ছিল মরিচ, সুপারি ও নারকেল। ১৯৬০ ও ১৯৭০ সালের দুই দফা ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপকভাকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ অঞ্চলের সুপারি বাগান। সবচেয়ে সচ্ছল শ্রেণীটির অবস্থাও শোচনীয় হয়ে পড়ে। বাড়তে থাকে জনসংখ্যার চাপ। কাজের সন্ধানে তারা পাড়ি জমাতে থাকেন আশপাশের জেলাগুলোয়। আরো পরের দিকে দেশ ছেড়ে বিদেশে— সৌদি আরব থেকে লন্ডন পর্যন্ত। তাদের পাঠানো আয়ই মূলত বদলে দিয়েছে এ অঞ্চলের অর্থনীতি।
জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক নোয়াখালী অঞ্চলের। শীর্ষস্থানে থাকা ফেনী জেলার ২৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ পরিবারই প্রবাসী আয়নির্ভর। নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ক্ষেত্রে এ হার যথাক্রমে ১৮ দশমিক শূন্য ২ ও ১৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। বৃহত্তর নোয়াখালীর তিন জেলার প্রায় ২০ শতাংশ পরিবার প্রবাসী আয়ে সমৃদ্ধ।
২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর নোয়াখালী থেকে প্রায় পাঁচ লাখ জনশক্তি বৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এর মধ্যে নোয়াখালী জেলা থেকে গেছেন ২ লাখ ১০ হাজার, ফেনী থেকে ১ লাখ ৪৫ হাজার ও লক্ষ্মীপুর থেকে ১ লাখ ২০ হাজার। বিপুল সংখ্যায় বিদেশে থাকায় এ অঞ্চলের কোনো কোনো গ্রামের নামই পাল্টে গেছে। কোনো গ্রামের নাম ‘লন্ডনিপড়া’ তো অন্যটির নাম ‘দক্ষিণ কোরিয়া’।
মেঘনার তীরেই নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা। শিক্ষা-সংস্কৃতি-সমৃদ্ধি সবকিছুতেই অন্য উপজেলার চেয়ে আলাদা সুবর্ণচর। উপজেলার চরবাটা গ্রামের বাদল তালুকদার ৩০ বছর আগে ‘ওমান’ পাড়ি দেন। পরে ছোট দুই ভাইকেও নিয়ে যান। ভূমিহীন দরিদ্র পিতার এ তিন সন্তানই এখন সচ্ছল। পরিবারের সবাইকে শিক্ষিত করেছেন। প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি করেছেন পাকা বাড়ি।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হাউজিং কন্ডিশন অব বাংলাদেশ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সালে ফেনী জেলার ১৬ শতাংশ বাড়ি পাকা, আর আধাপাকা ঘর রয়েছে ১৭ শতাংশ। জেলায় ঝুপড়ি ঘর নেই বললেই চলে, মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ। নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের ক্ষেত্রে পাকা ও আধাপাকা ঘর প্রায় ২০ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের রেমিট্যান্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিবারের ১৬ শতাংশ ঘরের ছাদ কংক্রিট। রেমিট্যান্সবহির্ভূত পরিবারের ক্ষেত্রে এ হার ১০ শতাংশ।
লক্ষ্মীপুর সদরের গন্ধর্ব্যপুর গ্রামের দুলাল মিয়া। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ১০ শতাংশ জমি বিক্রি ও ধারদেনা করে ২০০৫ সালে পাড়ি জমান ওমানে। সেই থেকে তার পরিবারে শুধুই সমৃদ্ধির গল্প। বর্তমানে এক একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে পাকা বাড়ি। সন্তানরাও পড়ছে এলাকার নামি স্কুলে।
অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এ অঞ্চলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিও। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রতিবেদনে ঢাকার পরই জায়গা করে নিয়েছে ফেনী। ১৬ লাখ ৩ হাজার ৭০ জনসংখ্যার জেলাটির ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ৭ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে মাথাপিছু আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা। এছাড়া ৩৪ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮০ জনসংখ্যা অধ্যুষিত নোয়াখালী জেলার আমানত রয়েছে ৮ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। আর ১৯ লাখ ২৮ হাজার ৫২৮ জনসংখ্যার লক্ষ্মীপুর জেলার ব্যাংক আমানত রয়েছে ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। এ দুই জেলায় মাথাপিছু আমানত যথাক্রমে ২৪ ও ২২ হাজার টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, আমার যেটা মনে হয়, এ অঞ্চলের মানুষের কর্মপ্রবণতা, কর্মোদ্যোগ, শিল্পপতিদের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে আজকের এ সমৃদ্ধি। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সার্বিক অবকাঠামো দুর্বল ছিল। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে গ্যাস-বিদ্যুত্ কিছুই ছিল না। আগেকার দিনে অধিকাংশ মানুষ দরিদ্রতার মধ্যে দিন কাটালেও বর্তমানে সে চিত্র ভিন্ন। এর একটা বড় কারণ হলো, এ অঞ্চলের মানুষ খুবই কর্মঠ। কাজ ছাড়া এ অঞ্চলের মানুষ থাকতে পারে না। পাশাপাশি এ অঞ্চলে বহু শিল্পপতি রয়েছেন, যারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্প-কারখানা নির্মাণ করছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে এ অঞ্চলের লোকদের চাকরির সুযোগ হয়েছে।
দারিদ্র্যের নিম্নহারে অন্যান্য জেলার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে আছে বৃহত্তর নোয়াখালী। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নোয়াখালী জেলায় দারিদ্র্যের হার মাত্র ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া ফেনী জেলায় দারিদ্র্যের হার ২৫ দশমিক ৯ ও লক্ষ্মীপুরে ৩১ দশমিক ২ শতাংশ।
ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. আমিন উল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, আশির দশকের আগ পর্যন্ত এ অঞ্চলে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল খুবই কম। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ছিল দুর্বল। প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামই নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষকে বহির্মুখী করেছে। তারা তখন ঢাকা-চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তীতে বিদেশে গিয়ে আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন নোয়াখালীর সুমন ভৌমিক ও ফেনীর নুরউল্যাহ কায়সার। বণিক বার্তা।