জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীতকরণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এটি ২০১৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষানীতিতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলা হয়। অথচ নির্ধারিত এসব পদক্ষেপের কোনোটিই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি বাস্তবায়নের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাও গৃহীত হয়নি। ফলে এত অল্প সময়ের মধ্যে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদরা।
প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে আট বছরে সম্প্রসারণে শিক্ষানীতিতে দুটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। এর একটি অবকাঠামোগত উন্নয়ন। অন্যটি হলো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরি। এজন্য ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সম্প্রসারণে প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে অনতিবিলম্বে কিছু কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়।
এগুলো হলো— প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার নতুন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক নির্দেশিকা প্রণয়ন, প্রাথমিক পর্যায়ের সব শিক্ষকের জন্য শিক্ষাক্রম বিস্তারসহ শিখন-শেখানো কার্যক্রমের ওপর ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাস করা। পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শ্রেণীকক্ষ বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপযুক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করতে অতিরিক্ত শিক্ষক ও লোকবল নিয়োগের সুপারিশও করা হয়েছে।
কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত ও সুপারিশের কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি এখনো। অথচ নিম্ন মাধ্যমিক তিনটি গ্রেডকে প্রাথমিক শিক্ষায় একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে সরকার। শিক্ষানীতিতে ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে একীভূতকরণের প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘাটতি সুস্পষ্ট। এজন্য সংশ্লিষ্ট দুটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন শিক্ষাবিদরা। পাশাপাশি প্রস্তুতি ছাড়া এটি বাস্তবায়ন করলে তিন স্তরের শিক্ষায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
এ বিষয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়াম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করতে শিক্ষানীতিতে বর্ণিত করণীয় পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। আমরা ২০১১ সাল থেকেই এর বাস্তবায়ন শুরুর কথা বলেছিলাম। তখন বাস্তবায়নে সাত-আট বছর সময় লাগবে বলে বলা হয়েছিল। সে সময় শুরু করলে এতদিনে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হতো।
শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, বাস্তবায়নের জন্য আগে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যা এখনো হয়নি। দুটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার ফলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এরই মধ্যে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান হয় এমন ২ হাজার ৩৮১ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত ৫৫৩ ও নন-এমপিওভুক্ত ১ হাজার ৮২৮টি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে সবার আগে দরকার প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যক্রম প্রণয়ন। বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাস জরুরি।
এদিকে প্রাথমিকে আগের পাঁচটি গ্রেডেই রয়েছে শিক্ষক সংকট। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রাথমিকে প্রতি ৪২ শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র একজন শিক্ষক রয়েছেন। সেখানে নতুন করে আরো তিনটি গ্রেড যোগ করা হলে মোট আটটি গ্রেডের শিক্ষার্থীদের পাঠদান প্রক্রিয়ার সংকট আরো গভীর হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য হলেও স্কুল ম্যাপিং কার্যক্রমের মাধ্যমে ২০ হাজার স্কুলে সম্প্রসারিত প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা করতে হবে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী চালুর ফলে এসব বিদ্যালয়ে কমপক্ষে ১ লাখ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রথমেই সমন্বয়হীনতার বিষয়টি সামনে এসেছে। এতে তিন স্তরের শিক্ষায় বিশৃঙ্খলা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রথমেই নতুন অবকাঠামোর দিকে না গিয়ে কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করতে হবে। একই সঙ্গে কিছু উচ্চ বিদ্যালয়কেও প্রাথমিকে রূপান্তর করা যেতে পারে।
এছাড়া বর্তমান শিক্ষক দিয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করানো প্রাথমিক শিক্ষায় অন্যতম চ্যালেঞ্জ। কারণ প্রাথমিকের অনেক শিক্ষক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস। এছাড়া প্রাথমিকে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই। অথচ ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর পাঠদানে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক থাকা আবশ্যক। তাই বর্তমান শিক্ষকদের অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, এটি একটি বড় কর্মযজ্ঞ। এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এর মধ্যে ক্লাস পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিও চলে আসে।
এদিকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন ১৯৯০ অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষা হবে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। পূর্ববর্তী আইন সংশোধন না করে নতুন আইন প্রণয়ন করায় একীভূতকরণের এ প্রক্রিয়ায় আইনগত ভিত্তিও তৈরি হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব হুমায়ন খালিদ বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রাথমিক পর্যায়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করার কথা বলা আছে, যা সংসদে পাস হয়েছে। এর বাস্তবায়নে আমাদের মন্ত্রণালয় আগে থেকেই যাচাই-বাছাই কাজ শুরু করেছে। এতে একটু বেশি সময় লেগেছে। সবকিছু একদিনে পরিবর্তন সম্ভব নয়। আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পেরেছি। এখন সবার সহযোগিতা থাকলে ধীরে ধীরে এর বাস্তবায়ন করা হবে।বণিক বার্তা।
০
.