দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকারীভাবে কর্মী নিয়োগ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ কোরিয়া আসতে মরিয়া। এই সুযোগে দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষার বিজ্ঞাপন দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু অসাধু এজেন্সী। মালয়েশিয়া কিংবা ইংল্যান্ডের মত ভিসা কলেজ না থাকায় দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষার নাম দিয়ে আদম পাচারের ঘটনা দুইতিনবছর আগেও দেখা যায়নি। সম্প্রতি একটি কলেজের নাম দিয়ে ঢাকার কয়েকটি কনসাল্টন্সী ফার্ম হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
যেভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা
দক্ষিণ কোরিয়ার শহর দেজনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উসং ইউনিভার্সিটি। দক্ষিণ কোরিয়ার কোন র্যাংকিং এ নাম না থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের নাম সলব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অব বিজনেস (SolBridge International School of Business)। কোরিয়ানদের এই বিজনেস স্কুল সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও অনেক বিদেশী স্টুডেন্ট ভালভাবেই চিনেন এই কলেজকে ভিসা কলেজ হিসেবে। এই বিজনেস স্কুলের নাম দিয়ে গত তিন সেমিস্টারের ধারাবাহিকতায় এবারও ঢাকায় সেমিনারের আয়োজন করে কয়েকটি এজেন্সী। প্রথম আলোসহ জাতীয় দৈনিকগুলোতে বড় বড় নজরকাড়া বিজ্ঞাপন দেওয়ায় গ্রামের ছাত্রীছাত্রীদের অনেকেই বেশ আগ্রহী হয় যাদের মূল চিন্তাভাবনা থাকে কোরিয়ায় গিয়ে আয় রোজগার করা।
Korean University Application Center (KUAC) নামের একটি প্রতিষ্ঠান গত ১০ এবং ১১ অক্টোবর ঢাকায় সেমিনারের আয়োজন করে। বিজ্ঞাপনে দেওয়া ফোন নাম্বারে কল দিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তারা বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। শুধু অফিসে গেলেই বিস্তারিত জানানো হবে বলে জানান। পরে আবার ফোন দিয়ে অনুনয় বিনয় করে প্রতিবেদক চট্রগ্রামের ছাত্র পরিচয় দিয়ে কোরিয়ায় পড়াশোনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকেন। ফোন রিসিভ করা ব্যক্তি জানান টাকার পরিমাণ শুধু অফিসে আসলেই জানানো হবে। তিনি জানান তাদের মাধ্যমে অনেক ছাত্রছাত্রী উসং ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে। তারা সেখানে পার্টটাইম করেই অনেক টাকা আয় করেন। উসং ইউনিভার্সিটি কোথায় জিজ্ঞেস করলে সিউলে বলে জানান (উসং ইউনিভার্সিটি দেজন শহরে অবস্থিত)। ভুল তথ্যের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা প্রতারিত হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি এই বিষয়ে কথা বলতে পারবেন না বলে লাইন কেটে দেন।
এইরকম একটি এজেন্সীর মাধ্যমেই সলব্রিজে আসা এক স্টুডেন্ট জানান ‘ প্রত্যেক এজেন্সী শত শত ফাইল ওপেন করেছে এই ইউনিভার্সিটির নামে। অথচ এদের কয়েকজন মাত্র ভিসা পায়। দুই আড়াই বছর ধরে বিভিন্ন এজেন্সীর মাধ্যমে এই ইউনিভার্সিটিতে স্টুডেন্ট আসা শুরু হয়েছে। হিসেব করে দেখলে প্রায় ৮/১০টা এজেন্সী সেমিনারের মাধ্যমে স্টুডেন্টদের ফাইল ওপেন করিয়েছে চার/পাঁচ সেমিস্টার ধরে হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রীর। অথচ এখন পর্যন্ত এই ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সবমিলিয়ে ১৭জন। অর্থাৎ এক সেমিস্টারে একটা এজেন্সী থেকে একজনের বেশি ভিসা পায়নাই। এইসব এজেন্সীর মূল আয় আসে চার্জ থেকে। কোরিয়ার প্রতি ইদানিং মানুষের আগ্রহ বেশি থাকায় এক দুইলাখ টাকা দিতে কার্পণ্য করেনা। এসব এজেন্সীর প্রায় সবগুলোই প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা চার্জ নেয়। ভিসা না হলে এর ৫০ শতাংশ ফেরত দেয়। অনেক এজেন্সী তাও দেয়না। ভিসা না হলে এসব প্রতিষ্টানের মাধ্যমে টিউশন ফি ফেরত পাওয়াও দুস্কর হয়ে পড়ে।
উসং ইউনিভার্সিটি, সলব্রিজ ও রাজেশ লজর
কোরিয়ান সার্চ ইঞ্জিন নেভারে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী উসং ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুল সলব্রিজের কার্যক্রম শুরু করে ২০০৯সালে। তারপর থেকেই বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি শুরু করে। বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করানোর জন্য ভিয়েতনাম এবং চীনে তাদের প্রতিনিধি নিয়োগ করে। দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে বাংলাদে্ ভারত এবং পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের আকর্ষন করার জন্য ভারতের পাঞ্জাবের ছেলে রাকেশকে নিয়োগ করে। রাজেশ সলব্রিজ থেকেই বিবিএ এবং এমবিএ করেছেন বলে জানা যায়। রাকেশের মূল কাজ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ঘুরে বেড়ানো আর স্টুডেন্ট ভর্তি করানো।
সলব্রিজে পড়াশোনা কেমন জিজ্ঞেস করলে বিবিএ’র বাংলাদেশীর ছাত্র তারেকুল ইসলাম আপন জানান “পড়াশোনার মান খারাপ না। কিন্তু পড়াশোনার পর ভবিষ্যত নিয়ে সবাই চিন্তিত। কোরিয়ান ভাষায় খুব বেশি দক্ষ না হলে কোরিয়ায় চাকরি পাওয়া কঠিন কাজ। স্কলারশীপ নিয়ে পড়াশোনা করলে এই ইউনিভার্সিটি খারাপ না। কিন্তু পার্ট টাইম কাজ করে ইউনিভার্সিটির ক্লাস করা এবং ভাল রেজাল্টের চিন্তা করা যায়না। আমার সাজেশন হবে স্কলারশীপ ছাড়া যেন এভাবে কোরিয়াতে কেউ না পড়াশোনা করতে না আসে।
প্রতারণা শিকার একজন ছাত্রের বক্তব্য
আমার নাম করিম (ছদ্মনাম)। পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে গুলশানের একটি ফার্মের সাথে যোগাযোগ করি। তারা সবমিলিয়ে আমার কাছ থেকে প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা নেয়। কোরিয়া আসার স্বপ্নে বিভোর থাকায় আমার বাবা যেকোনভাবে এই টাকা ম্যানেজ করে দেন। কিন্তু কোরিয়া এসে দেখি বাস্তবতা কত কঠিন। তারা বলেছিল যেদিন কোরিয়া আসব এর পরেরদিন থেকেই কাজ করে মাসে এক লাখ টাকা করে আয় করতে পারব। কিন্তু এখানে প্রথম ছয়মাস কাজের পারমিশন নাই। আর পার্ট টাইম কাজও নাই। অনেক কষ্ট করে কোনমতে একটা কাজ জোগাড় করেছি। যেটা অবৈধভাবেই করছি। পার্ট টাইম দিয়ে যা আয় হয় টা দিয়ে নিজে চলা খুবই কষ্টকর। আর কাজ করে এখানে পড়াশোনা করা সম্ভব না। এই সেমিস্টারে একজন ছাত্র এসেছে যার যার বাবা দেশে আলুর চাষ করে। জমিজমা বিক্রি করে প্রায় ৯ লাখ টাকা খরচ করে তাকে কোরিয়ায় পাঠিয়েছে। এখানে এসে দেখে সে বৈধভাবে কাজ করতে পারবেনা। এখন পড়াশোনা বাদ দিয়ে অবৈধ হয়ে কাজ করে। ধরা পড়লে যেকোন সময় তাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া এজেন্সীগুলো বলে কোরিয়ায় পড়া শেষ করে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সী পাওয়া যাবে। কিন্তু এখানে এসে দেখি কোরিয়ার ভাল ভাল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরাও চাকরি পাচ্ছে না। পার্মানেন্টতো অনেক দূরের কথা। কোরিয়ান ভাষা ভাল না জানলে চাকরি পাওয়া খুবই দুস্কর। এজেন্সীগুলোর কোন ধারণাই নাই কোরিয়া সম্পর্কে। কয়েকজন এখান থেকে পাশ করে বের হয়েছেন যাদের কেউই চাকরি পাননি।
প্রতারণা এড়াতে…
বর্তমানে প্রায় ৬৮০ জন বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রী কোরিয়ায় পড়াশোনা করছে। যাদের বেশিরভাগই স্কলারশীপ নিয়ে পড়াশোনা করছে। কাজের সুযোগ কম থাকায় স্কলারশীপ ছাড়া কোরিয়ায় পড়াশোনা করা কঠিন। মাস্টার্স পিএইচডিতে সহজে স্কলারশীপ পাওয়া গেলেও আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে স্কলারশীপ পাওয়াটা অনেক কঠিন। দক্ষিণ কোরিয়া স্কলারশীপ, ভর্তি তথ্য এবং পড়াশোনা বিষয়ক সহযোগিতা দিয়ে আসছে বাংলাদেশী স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন ইন কোরিয়া (বিএসএকে)। তাদের সাথে মেইলে যোগাযোগ করে কিংবা ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জেনে নেওয়া যাবে।
বাংলাদেশী স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন ইন কোরিয়া (বিএসএকে) – http://www.bsak.org/
ফেসবুক পেইজ- https://www.facebook.com/Hi.BSAK
এছাডা দক্ষিণ কোরিয়ায় পড়াশোনার ব্যাপারে সহযোগিতা করছে হাইয়ার স্টাডিজ এব্রড, সাউথ কোরিয়া চ্যাপ্টার। কোরিয়াতে অধ্যয়নরত একদল তরুণ কোরিয়ায় পড়তে ইচ্ছুকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি দিয়ে সহায়তা করে থাকেন। সেই গ্রুপ থেকেও আপনি যাবতীয় সহায়তা নেওয়া যাবে।
https://www.facebook.com/groups/HSA.SouthKorea/