আমরা মাঝে মাঝে দেখি দক্ষিণ ও উওর কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ লাগে লাগে অবস্থা হয়। কিন্তু কি থেকে যেন কি হয়ে যায় যুদ্ধ আর লাগেনা। উভয় পক্ষ আলোচনায় বসে খুব স্বল্প সময়ে ওম শান্তি ওম শান্তি করতে করতে হাসি মুখে করমর্দন করে যে যার মত ঘরে ফিরে যায়। এর মানে এই নয় যে আমি যুদ্ধ কামনা করি।
এইতো কয়েকদিন আগে দক্ষিণ ও উওর কোরিয়ার মধ্যে এমন এক যুদ্ধাবস্হার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল কাছুই হলোনা। উভয় কোরিয়ার উর্ধতন ব্যাক্তিরা আন্তর্জাতিক রেখার উভয় পাশে বসে প্রথমে গম্ভীর মুখে এবং অল্প পরে অকর্ণ হাসিমুখে করমর্দন করে শান্তি শান্তি করতে করতে ফিরে গেলেন। এটা এখন একটা অতি পরিচিত ও প্রচলিত বিষয়ে পরিনত হয়েছে উভয় কোরিয়ার মধ্যে। আমি উনিশ সাতাশী / আটাশী সালে চীনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটিতে যাই কোর্স করার জন্য। বেইজিং থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দুরে ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির ফরেন উইং চাম্পিং কাউন্টিতে । এখানে আমরা বাংলাদেশের পনের জনের মত ষ্টুডেন্ট অফিসার কোর্স করছি। সুন্দর জায়গা এবং সুন্দর পরিবেশে আমাদের কোর্স চলছে। যেহেতু আমার আলোচনার উদ্দেশ্য চীনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটিতে কোর্সের খুঁটিনাটি বর্ননা করা নয় তাই আসল বিষয়ে ফিরে যাচ্ছি। তবে একদিন আমি আমাদের ফরেন উইং এর একজন জেনারেলের সাথে আলাপচারিতায় জানতে পারলাম যে ১৯৪৯ সালের পুর্বে চীন বিদেশের সাথে কোনো সংঘাতে জড়াবেনা। এই সময়টা তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যায় করবে। চীন সেদিকেই চলছে মনে হয়। আরো একটি মজার জিনিস জেনেছিলাম ঐ জেনারেলের কাছথেকে তাহচ্ছে চীনে যাই ঘটুক যে অর্থনৈতিক ব্যাবস্হাই আসুক চীন পিকিং ম্যানই থাকবে কোনো পরিবর্তন হবে না। যদিও জাপানের সাথে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের টানাপোড়েন আছে। কিন্তু চীন এখনও জাপানের সাথে সরাসরি সংঘাতে যায়নি।
তো একটা বিষয় নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি তাহল এতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরেও উওর কোরিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকা কেন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেনা? আমরা দেখছি উওর কোরিয়া আমেরিকাকে পর্যন্ত হুমকি ধমকি দিচ্ছে আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে হামলা করার। কিন্তু কৈ কোনো শাস্তিতো উওর কোরিয়া পাচ্ছে না।
আমেরিকাতো কম্যুনিস্ট উওর কোরিয়ার রগে রগে থাকার কথা কিন্তু আমরা দেখছি আমেরিকা উওর কোরিয়ার সব বাড়াবাড়ি অবলীলায় হজম করে যাচ্ছে। কেন এমন হয় এবং হচ্ছে? আমার দৃঢ় ধারনা কোরীয় উপদ্বীপে আমেরিকার স্বার্থরক্ষার বড় একটা ভুমিকা পালন করছে উওর কোরিয়া। কিন্তু আমরা সাদা চোখে এই কুটনিতী দেখতে পাচ্ছিনা । উওর কোরিয়া কনের পিসি এবং বরের মাসি সেজে যেমন চীনের কোলে বসে আছে তেমনি কোরীয় উপদ্বীপে আমেরিকার স্বার্থরক্ষা করছে :
১। উওর কোরিয়া চীনের এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে বাফার স্টেট হিসাবে চীনের স্বার্থ রক্ষা করছে।
২। জাপানকে মাঝে মাঝে বোমা মারার হুমকি দিয়ে উওর কোরিয়া চীনকে খুশী রাখছে।
৩। দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানকে হুমকি দিয়ে উওর কোরিয়া কোরীয় উপদ্বীপে এবং জাপানের নিকট আমেরিকার উপস্থিতিকে অপরিহার্য করে তুলছে।
এমন সোনার ডিম যে হাঁস দেয় তার অপরাধতো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হয় বৈকি! আমেরিকা উওর কোরিয়ার ব্যাপারে তাই করছে। মজার ব্যাপার হলো চীন বাজার অর্থনীতি গ্রহন করার পরে তার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পলিসিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। চীন গোপনে গোপনে চায় দুই কোরিয়ার একত্রীকরন হোক, দুই কোরিয়া এক হোক। এতে চীনের যা অর্জিত হবে:
১। প্রথম অর্জন হল আমেরিকা কোরীয় উপদ্বীপ থেকে বিদায় নিবে। যা চীনকে বিশ্ব শক্তি হতে অনেক ধাপ এগিয়ে নিবে।
২। দুই কোরিয়া এক হলে দক্ষিণ কোরিয়া শত্রু থেকে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশীতে রুপান্তরিত হবে। যা চীনের জন্য অতি জরুরী একটি পাওয়া।
৩ । উওর কোরিয়া চীনকে যে তোষন করছে এবং উওর কোরিয়াকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে যে অর্থনৈতিক ড্রেনেজ চীনের হচ্ছে তা থেকে চীন রেহাই পাবে। যা চীনের জন্য বড় স্বস্তির কারণ হবে।
৪। চীন একিভুত কোরিয়ার সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হবে। যা চীনের অর্থনৈতিক গতিধারাকে আরো গতিশীল করবে।
৫। কোরিয়া একত্রিত হলে চীনের পক্ষে জাপানের মোকাবেলা করা সহজ হবে। এবং চীনের বিশ্বশক্তি হবার পথ প্রশস্ত হবে।
৬। চীনের ঘরের দরজার সামনে উওর কোরিয়ার মত একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র চীনের জন্য যে মথাবেথার কারন হয়ে আছে তা থেকে চীন মুক্ত হবে।
শুধু কম্যুনিস্ট বলে নয় আসলে চীন উভয় কোরিয়ার একত্রিকরন চায় নিজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, কুটনৈতিক ও সাট্রাটেজিক প্রয়োজনে যা সাদা চোখে অনেক সময় ধরা দেয় না। যেমন ধরা দেয় না উওর কোরিয়ার কোরীয় উপদ্বীপে আমেরিকার স্বার্থরক্ষার কুটনিতীর কুটকৌশল।
লেখক : কলামিস্ট ও প্রাক্তন মহাপরিচালক (বিডিআর) জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান