অবৈধ মাদক ব্যবসায় মদদ ও অভিযানে বাধা দেয়ার কারণে দূতাবাসকে সতর্ক করা হলো।
সম্প্রতি দেয়া এক চিঠিতে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের মে মাসে রাজধানীর বনানীতে পিয়ংইয়াং রেস্টুরেন্টে অভিযান পরিচালনার সময় আইন-শঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর চড়াও হন উত্তর কোরিয়া দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তা। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে ওই অভিযানে অংশ নেয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও সরকারের একটি শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। গভীর রাতে পরিচালিত ওই অভিযানের সময় সেখানে হাজির হন কমার্শিয়াল কাউন্সিলর মি. মিং হানসহ উত্তর কোরিয়া দূতাবাসের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। বাংলাদেশের আইন ও অভিযানের বিষয়ে জানানোর পরও তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজে বাধা দেন। একটি গোয়েন্দা সংস্থার এমন প্রতিবেদনের পর সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় অবস্থিত উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে চিঠি দেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৪ মে বনানীর ২৭ নম্বর রোডের ১৫ নম্বর বাড়িতে পিয়ংইয়াং নামে একটি রেস্টুুরেন্টে অভিযান চালায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। উত্তর কোরিয়ায় নাগরিক বায়াগ সুনসহ পাঁচজন ২০০৯ সালে ওই রেস্তোরাঁটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের কাছে খবর ছিল, ঢাকার উত্তর কোরিয়ার দূতাবাস এ রেস্তোরাঁটির ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও কিছু কর্মকর্তা নেপথ্যে থেকে এদের বিভিন্ন সহায়তা দিচ্ছেন। কোনো প্রকার অনুমোদন না থাকলেও বিদেশি নাগরিক হিসেবে ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউস থেকে শুল্কমুক্ত কোটায় মদ-বিয়ার এনে এ রেস্তোরাঁয় সরবরাহ করা হচ্ছে। এর একটি বড় অংশ কালোবাজারে বিক্রি করার অভিযোগ আসে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের কাছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে অভিযান চালানো হয়।
অভিযান চলাকালে কমার্শিয়াল কাউন্সিলর মি. মিং হানসহ উত্তর কোরিয়া দূতাবাসের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ছুটে আসেন এবং অভিযান পরিচালনা না করার জন্য গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের চাপ দেন এবং ভয়ভীতি দেখান। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন এবং সার্চ ওয়ারেন্ট সম্পর্কে দূতাবাস কর্মকর্তাদের অবহিত করলেও তারা আটককৃতদের ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। পরে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অভিজাত ওই রেস্তোরাঁটির মালিক কোরিয়ান নাগরিক রায়াগ সুনকে গ্রেফতার করে। তবে বাধার মুখে গ্রেফতার করা যায়নি ওই রেস্তোরাঁর কর্মচারী ও খরিদ্দার থাইল্যান্ড এবং কোরিয়ার বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণীকে। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, বিয়ার ও যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট। এ ঘটনায় বনানী থানায় মাদকদ্রব্য আইনে একটি মামলা দায়ের হয়। মামলা নম্বর-১১। তারিখ ১৫/৫/২০১৫।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিয়ংইয়াং রেস্টুুরেন্টের নিচতলায় রেস্টুরেন্ট ও বার, দ্বিতীয় তলায় বারসহ নিয়মিত নাচ-গানের আসর বসত। তৃতীয় তলায় ছিল অন্তত ১০ কক্ষের রংমহল। এখানে দেশি-বিদেশি তরুণীরা আগতদের মনোরঞ্জন করতেন।
অভিযানের দু’দিন পর শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদফতরের পক্ষ থেকে ১৬ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে মি. মিন হানসহ ঢাকার কোরিয়ান দূতাবাস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণের বিষয়টি অবগত করা হয়। ১৭ মে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। ওই চিঠির স্মারক নম্বর-০৮.০১০০০০০৬৩.০৫.০০১.১৫/১৩ (১০)। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চলতি বছরের ২৭ মে ঢাকায় উত্তর কোরিয়ার দূতাবাস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে সতর্ক করে। যার স্মারক নম্বর-পিআরও/ডিসিপি/(এমএস-১)-৮/৫১/১৫। এ সংক্রান্ত সব প্রমাণাদি সংরক্ষিত রয়েছে।
এর আগে, চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উত্তর কোরীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি (ইকোনমিক) সন ইয়াম ন্যামকে আটক করে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদফতরের কর্মকর্তারা। এ সময় তার সঙ্গে থাকা লাগেজ তল্লাশি করতে গেলে বাধা দেন সন ইয়াম ন্যাম। এ নিয়ে তার সঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বাকবিত-ার ঘটনাও ঘটে। খবর পেয়ে উত্তর কোরীয় দূতাবাসের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিমানবন্দরে ছুটে গিয়ে তল্লাশি ছাড়া লাগেজটি ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। তবে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদফতরের কর্মকর্তারা সন ইয়াম ন্যামকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কাছে হস্তান্তর করেন। এপিবিএন সদস্যরা তার লাগেজ থেকে অবৈধভাবে আনা প্রায় ২৭ কেজি চোরাই সোনা উদ্ধার করে। ওই ঘটনার পর উত্তর কোরিয়া সরকার অভিযুক্ত সন ইয়ামকে দেশে ফিরিয়ে নেয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মঈনুল খান বলেন, সেদিনের অভিযানে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঢাকার উত্তর কোরীয় দূতাবাস কর্মকর্তারা যে আচরণ করেন তা শুধু শিষ্টাচারবহির্ভূত বললে কম বলা হবে। তারা আইন-শঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ভয়াবহ অসদাচরণ করেন। এ ঘটনায় গ্রেফতার পিয়ংইয়াং রেস্টুরেন্টটির মালিক উত্তর কোরিয়ার নাগরিক রায়গ সুন ইতিমধ্যেই আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। তবে তদন্ত কর্তৃপক্ষ এ মামলাটির চার্জশিট আদালতে দাখিল করেছেন বলে ড. মঈনুল খান জানান। মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে রায়গ সুনের দুই বছরের সশ্রম কারাদ- ও জরিমানা হতে পারে।
একই অপরাধে বাংলাদেশি কোনো নাগরিক গ্রেফতারের পর অভিযোগ প্রমাণ হলে যাবজ্জীবন পর্যন্ত সাজা হওয়ার বিধান রয়েছে।