অফিসের সবাই চলে গেছে, কাল রবিবার, কাজ চলবে কালও, এশিয়ানদের একটু বেশি কাজ করতে হয় যোগ্যতা প্রমাণে, পজিশন ঠিক রাখতে, বিশেষ করে ছোট সার্টিফিকেটে যখন বড় কাজ করতে হয়, কাজের মাত্রা, চাপ একটু বেশি হয়। আমি ডিপ্লোমা, বিএসসি নই, কাজ চালিয়ে যাচ্ছি অনেক বছর ধরে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের। কখনো অফিস, কখনো কাজের সাইট। যেন সব পাতিলের তরকারি। আগে সৌদি আরবে বয়স্ক কাউকে দেখলে বলতাম এতদিন বিদেশ করা লাগে নাকি? এখন বুঝি আমি ভুল ছিলাম। বাস্তবতা ভিন্ন। ইচ্ছে করলেই উড়াল দিতে পারি না প্রিয়জনের কাছে হাতটান আর কাজের চাপ বাধা হয়ে দাঁড়ায়, প্রয়োজনের শিকলে বাঁধা আমি। দায়িত্বের বোঝা আমার কাঁধে, তাই কাজ করে যাই যখন যেথায়। সম্ভবত এ কারণেই একুশ বছরে কোম্পানির সংখ্যা মাত্র চার দেশ-বিদেশ মিলিয়ে। এখনো মনে হয় আজি শুরু করলাম কাজ, করতে হবে আমরণ। অবসর হয়ত পাব হয়ত না। যদিও না পাওয়ার পাল্লা বেশি ভারী।
শিক্ষার যে যোগ্যতা এ সার্টিফিকেটে দেশে আগে যেমন অবমূল্যায়িত হয়েছিলাম নব্বইয়ের দশকে আজ গেলেও একই ফলাফল হবে, ফেসবুকের ইনবক্সে যখন দেখি আমার চেয়ে বড় ডিগ্রি নিয়ে শ্রমিক হিসেবে আসতে প্রস্তুত, তখন যাওয়ার কথা ভাবি কি করে? দেশ ছেড়েছিলাম ভাগ্যের সোনার হরিণের আশায়, হরিণের দেখা মেলেনি আজো, কিন্তু আমাকে ভুলেছে দেশ|
প্রয়োজনের ফর্দটা কাটছাঁট করার কোনো উপায় নেই, মৌলিক চাহিদা বাদে কি বেঁচে থাকা যায়? এই দূরে থাকা তৈরি করে দূরত্ব স্ত্রী-সন্তান, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে।
সম্পর্ক মাস শেষে একবার বেতনের সেই এক সপ্তাহ। এক তারিখ থেকে সাত তারিখ এই সময়টা যে অর্থ বিয়োগের। আমি দিতে পারলে আমি খুশি তারা পেলে তারা খুশি। এরপর সবার ব্যস্ততা। আমি এখানে ওরা ওখানে। একটা মজার ব্যাপার কখনো সন্ধ্যায় ফ্রি সময় পেলে ফোন করলে ফোন ধরার মানুষ নেই। কারণ কেউ ইবাদতে ব্যস্ত, কেউ মুরগি-হাঁস গোছাতে ব্যস্ত। ইবাদত বাদ দিলাম, মুরগি-হাঁসের ব্যাপারে আসি। তখন কি মনে হয় না আমার চেয়ে বাড়ির মুরগি-হাঁসের মূল্য বেশি!
জানি এটা কোনো শক্ত যুক্তি হলো না, এটা ওদের জীবনের অংশ, প্রাত্যহিক রুটিনে আছে। প্রবাসী কাজের মাঝে ফোন করলে কেউ কিছু বলার নেই, যদি উপয়ান্তু না দেখে, দেশে ফোন করলে কাজের সময় কথা বললে বিরাট দোষের হতে পারে বা হয়ে যায়। কোনো কোনো সময় এমন হয়, ফোন করলে ব্যস্ত থাকে, প্রবাসী বুঝতে পারে ফোন বিজি, পাসের মোবাইলে বা ঘরের অন্য মোবাইলে ফোন করে পাওয়া যায় ফোনে কথা চলছে, প্রয়োজনের তাগিদে! সবাই ব্যস্ত! কেউ মোবাইল রাখে ঘরে কাজ করে বাইরে, ব্যস্ততার কারণে মিসকলটাও দেখা হয় না তাদের!
রাত বারোটার পর বিদেশের সঙ্গে ঘন্টার পার্থক্যে ঘুমানির বিড়ম্বনাতে পড়তে হয়। যোগাযোগে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ভালোবাসা কমে যায়।
দেশে যে পুত্র-কন্যা থাকে পিতা-মাতার সামনে, পিতা-মাতার কাছে তিনি হয়ে উঠেন অন্ধের যষ্টি। যদি বাবা- মায়ের প্রিয় কাজ করতে পারেন কাছে থাকা ছেলে বা মেয়ে, সেখানে প্রবাসীর অর্থ-বিত্ত-সেবা, প্রবাসীর বউয়ের কর্মযজ্ঞ শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।
বিদেশে থাকায় রশি ছাড়া প্রবাসীদের বিবিজানেরা হয়ে উঠেন তুলনামূলক বিলাসী, স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী, মুক্তির সৈনিক। কেউ স্বাধীনতা পেলে ওই বিবিজান মুরব্বিদের চোখের আড়ালে কত কিলোমিটার দূরত্বে নানা রঙের-বৈচিত্র্যের ক্লাস করতে পারেন, কত জনকে ভাই ব্রাদার ভেবে প্রবাসীর অর্থ তুলে দিতে পারেন তাদের হাতে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার নাম করে কি করতে করতে পারেন (সবাই নয়) তা বলাই বাহুল্য। এর ফলে কি ঘটে তা আর কারো অজানা নেই|
দেশে গেলে প্রবাসীরা স্ত্রী-সন্তানদের কাছে পেতে চায়। কিন্তু সেখানে প্রবাসী পড়ে সমস্যায়। কেমন সমস্যা। দু-একটি বলি। গাছে তাল পেকেছে, মা-বোন-বউসহ বাকি সদস্যরা তাল নিচ্ছে, আমের দিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আচার তৈরি হচ্ছে, প্রবাসী বসে টিভি দেখে, এ ঘর থেকে ও ঘরে যায়, সময় কাটে না।
সকালে দেরি করে আয়েশ করে ঘুম থেকে উঠলে ঘরশুদ্ধ অভুক্ত। চার-পাঁচ বউ থাকলে দেখা যায়, যে সব সময় করছে ওই বউটাই বেশি ব্যস্ত, অন্য বউরা এগিয়ে আসে না প্রবাসীর বউকে ছাড় দিতে। কোনো বউ আবার মাঝারি গোছের ব্যস্ত, ধরি মাছ না ছুঁই পানি টাইপের, কোনো কোনো প্রবাসীও ছোট হয়ে হতে চান পরিবারের কর্তা, যদিও পরিবারের অন্য কর্তা ব্যক্তি সদস্যরা কোনো মূল্যায়ন করেন না।
ঘুমানো যাবে না বেশি, ওরে বাবা খবরদার ভোর পাঁচটা থেকেই রান্নাবান্না শুরু করার আহ্বান (সবাই নয়)। প্রবাসী যদি সামাজিক কর্মকা-ের মানুষ হয়, স্বভাবতই একটু বাইরে ব্যস্ত থাকতে হয়, এমন হলে এবার বাবা মায়ের কষ্ট, এটা পুরা জায়েজ। বাবা-মায়ের আক্ষেপ সময় দিল না সন্তান।
বউ যদি চাকরিজীবী হয়। বউ চাকরিতে প্রবাসী বেচারা কাভি ইধার, কাভি উধার। প্রবাসী চায় তখনি চলে আসবে প্রবাসে। নিজেকে ভাবে মূল্যহীন অপাঙক্তেয়। যেই সব প্রবাসী বিয়ের আগে ছুটিতে যায় তারা একটু বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সময় পার করে, বাবা-মা কিছু বলে না, ছেলে এসেছে একটু আনন্দ করুক। বিয়ের পর গেলে বন্ধুরা স্বাভাবিকভাবে দূরে চলে যায়, বউ যদি প্লান করে ঘুরতে যাবে তাহলেই হলো, সামনাসামনি কিছু না বললেও আড়ালে বলেন, শেষ করে ফেলল আমাদের ছেলেরে, ছেলেতো আমাদের না, বউয়ের! এই সব আওয়াজ যেকোনোভাবে আসবেই।
প্রবাসীরা গিফট দিয়ে কাউকে খুশি করতে পারে না। বিয়ের আগে আত্মীয়স্বজন বা পরিবারের সদস্যরা মেনে নিলেও বিয়ের পর সব শেষ বউ আর শ্বশুরবাড়ির ছুরির নিচে আসবেই। বউ বা শ্বশুরবাড়ি যদি এক আনাও না নেয় প্রবাসীর কাছ থেকে, তাও তারা সেই দোষে দুষ্ট হবে।
প্রবাসীর শ্বশুর সাহেবকে সে রকম সেবা-যত্ন না করতে পারলে বুক চাপড়িয়ে শ্বশুর বলেন, কোথায় দিলাম রে, আমার মেয়ের জীবন শেষ।
বোন জামাই ফুললি টেকনিক্যাল। বোন যে ভাইয়ের জন্য জীবন-মরণ, সে ভাইয়ের কাছ থেকে অর্থকড়ি আদায়ের আশায় নানা কলাকৌশল যেইভাবে প্রয়োগ করার করেই ছাড়বে। দু-একটি পরিবার যে ভালো নেই তা নয়। তবে বেশির ভাগ প্রবাসী মনের কষ্টে প্রবাসে ফিরে আসে।
কাজের চাপে প্রবাসে শান্তি পায় না। দেশে পায় না পরিবার-পরিজনকে খুশি না করতে পারার কষ্টে। খুব কম প্রবাসীকেই পাওয়া যায়, যারা দেশে গিয়ে জমি-জায়গা নিয়ে লড়াই করেন না, কোর্ট কাচারী হয় না। এই সেক্টরে আত্মীয়স্বজন বা ভাগিদাররা অপেক্ষায় থাকে প্রবাসীকে একটা ক্যাচা কিভাবে দেওয়া যায়, কতজন তো না পারেন সইতে, না পারেন কইতে।
অর্থ করি সম্মান নিয়ে বিবিজান যেই সব কর্ম করেন, সন্তানের মুখপানে তাকিয়ে সেই বউ নিয়ে সংসার ধর্ম চালিয়ে যান প্রবাসী।
আসা-যাওয়ার পথে বিদেশের এয়ারপোর্টে সম্মান পেলেও ঢাকা বা বাংলাদেশের বিমানবন্দর থেকে শুরু হয় ইজ্জত মানসম্মান অর্থ খোয়ানো, গাড়ি, ট্যাক্সি এমন কি বাড়ির দরজায় রিকশাওয়ালাও তাকে রেহাই দেয় না|
বিমানবন্দরে প্রত্যেক প্রবাসী যদি গোপন ক্যামেরায় ধারণ করে তার আসা-যাওয়ার দেশীয় বিড়ম্বনার চিত্র তাহলেই বোঝা যেত প্রবাসী কি দিল দেশকে আর দেশ কি উপহার দিল তাকে।
আম কাঁঠাল নারিকেল ডিম সিগারেট রান্না তরকারি আসার সময় যেভাবে রেখে দেন, বিমানবন্দরের লোভী কর্মচারীরা যাওয়ার বেলায় মদের বোতল সিগারেট ডলার দিনার রিয়েল সোনা সব রেখে দেওয়ার জন্য বিমানবন্দরের ঝাড়–দার থেকে সেই উপরের লেভেল পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় নামেন। জিহ্বায় পানি মুছতেও যেন দু-চারজন লাগে। বেল্টে মালামাল নিয়ে কি আর বলব, প্রবাসে সম্মানিত পর্যায়ে লিডিং জব করা লোককে গতবার আমি হতভম্ব হতে দেখেছি, আধা উন্মাদ হতে দেখেছি। সে আমারই চাচাত ভাই সব তার লিগ্যাল ছিল, শুধু শুধু হয়রানি। পরে আমি বাধ্য হয়ে বাংলার কণ্ঠ আর ঢাকাটাইমস-এর সাংবাদিক পরিচয় দিলে নমনীয় হয়, এখানে তারা ভেবেছিলেন আমি হয়ত হলুদ সাংবাদিক। আমি শ্রমিক বা ইঞ্জিনিয়ার বলে কাজ হয়নি। হলুদ সাংবাদিকতার প্রভাব আছে তাহলে!
বিদেশের মাটিতে কর্মস্থলে মালিক শ্রমিক বিড়ম্বনার শেষ নেই, যদি কোনো কাজে বাংলাদেশ হাইকমিশনের দারস্থ কেউ হয় তাহলে বোঝা যায় বিমানবন্দরে কেন কষ্ট পায় প্রবাসী। রাজনীতিতে ক্ষমতায় যেই আসে সেই স্বৈরাচারী হয়। এ যে রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে।
এখানে তো বিভিন্নজনের জীবনে ঘটে যাওয়া কয়েকটা খ-চিত্র তুলে ধরলাম। আরো কত ঘটনা রয়ে গেছে ধারাবাহিক লিখলেও শেষ হবে না। একটি যুক্তি ইয়ার দোস্তকে মাঝেমধ্যে দেই, তারা আমাকে কেউ নাস্তিক বা উন্মাদ বলে, কারণ এটা সম্পূর্ণই ধর্ম বিরোধী কথা, কেউ হয়ত আমায় গালিও দিতে পারে, তবুও লিখছি ক্ষমাও চেয়ে নিচ্ছি, এটা কাউকে কষ্ট দেওয়া বা ছোট করার জন্য নয়, বা আমি ধর্ম বিরোধী নই, এটা বিবেকে প্রশ্ন করা একটা উদাহরণ মাত্র। মনে করেন সেলিম বিদেশে থাকে, কামাই রুজি মন্দ নয়, তার বন্ধু রকিব তার চেয়ে আরো কম আয় করে, সেলিম পরিবার প্রিয় মানুষ, রকিব উল্লাসি জীবনযাপন, ক্লাব মদ জুয়া নিয়ে পড়ে থাকে, বিদেশে রকিব মিয়ার মাসটি চলে, তারুণ্য উপভোগ করে, সেলিমের কি তারুণ্য নেই, আছে অবশ্যই আছে, সেলিম অপেক্ষায় থাকে কবে দেশে যাবে তার স্ত্রীর আছে, তাকে নিয়ে সে ঘুরতে যাবে, এখানে সেখানে নানা প্লান করে, বিদেশে কোনো অবৈধ কাজ করে না সে। দেশে গেল সেলিম।
এক মাসের ছুটি, দুর্ঘটনাক্রমে অনেক দিন পর গাড়ি চালানোয় জার্নি ভালো হলো না, দিতীয় দিন গাড়িতে মাসিক সার্ভিসিংয়ের সময় আসে। চলে গেল সাত দিন বা চার দিন, তার পর শুরু হলো পারিবারিক ঝগড়া বউ-শাশুড়ি, বউয়ে-বউয়ে, দেবরে-ভাসুরে লেজে-গোবরে অবস্থা, নানা কিচ্ছা কাহিনি। এ অবস্থায় একটা ভালো জার্নি কে আসা করতে পারে। মন খারাপ, কেউ এ ঘরে কেউ ও ঘরে। আসার সময়ও সার্ভিং টাইম পড়ে অনেকের। ডাক্তার কবিরাজ নিয়ে টানাহেঁচড়া তো আছেই। এমন করে যেকোনো উপায়ে ১৫-১৬ বার গাড়ি চালান হলো। আসা-যাওয়ায় বা নানা খরচাদি মিলিয়ে লাখ তিনেক টাকা খরচ হলো, অনেকে বলে, রথ দেখা কলা বেচার কথা, তাহলে রথের খরচ বাদ দিলাম, পুরো দুই লাখ, রইলো কলা বেচার এক লাখ। ১৫ দিন গাড়ি চালানোর ভাড়া, তেল খরচ, প্রতিবারে খরচ ৬৬০০ টাকা। আর নামকরা দেশে একবার গাড়িতে চড়তে লাগে ২৪০০ টাকা। একটা তৃতীয় শ্রেণির যুক্তি এখানে লিখলাম কিন্তু প্রসঙ্গ একজন প্রবাসী অল্প দিনের জন্য দেশে যান, তাহলে তার প্রতিটা সময়ের মূল্য অনেক। এই প্রবাসীর প্রতি লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব কি পরিবারের দায়িত্ববানদের ওপর পড়ে না?
সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে যাবেন পারেন না, বউ নিয়ে খুনসুটি করবেন দরজা বন্ধ করে তা পারবেন না, স্বাধীন জীবনেও কেন যেন পরাধীনতা! পরিবারে অর্থকড়ির যোগানে প্রবাসী যদি বলে আমি পারছি না এত টাকা দিতে, পঞ্চাশ হাজার ম্যানেজ করছি, উঠে আসে অভিভাবকের পুরনো ইতিহাস, মনে করিয়ে দেয় অনেক কিছু, কেউ কেউ তো বলেই ফেলেন আরে দেশে মুচিচামারে এর চেয়ে বেশি কামাই করে, আত্মীয়স্বজন হাওলাত নিলে ফেরত দেওয়ার নাম পর্যন্ত থাকে না। এমন অনেক পরিবার আছে ছেলে বিদেশে নানা ঝামেলায় জড়িত, কিংবা হাসপাতালে অসুস্থ তারা জানেন দোয়া করছেন ছেলের জন্য কিন্তু যেকোনো শুভ কাজে ছেলের স্থিরতার অপেক্ষা করতে পারেন না। প্রবাসীর বউয়ের সন্তান হবে দিন-তারিখ ঠিক, সেই দিন আরেক ছেলে বা মেয়ের বিয়ের আয়োজন, যেন এ দেশে আর কোনদিন মেয়ে বা ছেলে পাওয়া যাবে না বিয়ে দিতে। অনেক ছেলে বিদেশ থেকে গিয়ে হুমকি ধামকি শুরু করেন, অন্য ভাইয়ের ভুল ত্রুটি নিয়ে টানাটানি মান সম্মান হানাহানি নিজের কথা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে মহাগেঞ্জাম।
মা-বাবা-ভাইকে ভুলে যায়, বউ যা বলে তাই ঠিক। জন্মদাতা মা-বাবা তার কাছে হয়ে যায় তুচ্ছ। প্রবাসী উন্মাদ হয়ে বিদেশে ফেরত আসতে চায়। এমন প্রবাসীকে অভিশপ্ত বলা যায়, কেউ এক বছর কেউ দু বছর কেউ বা আরো বেশি সময় পর দেশে যায় আনন্দ নিয়ে। আসার সময় প্রবাসীর বুক ভেঙে যায়। ছোট বড় যে বয়সের ছেলে-মেয়ে হোক ওদের ছেড়ে আসতে প্রবাসীর কি কষ্ট তা বলে বোঝানো যাবে না, দুর্ভাগ্যবশত নিজের বুদ্ধি বিলুপ্তি অর্থের অহংকার শ্বশুর বাড়ি কিংবা দুষ্টু মনের বউয়ের প্ররোচনায় যারা বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের সাময়িক বা দীর্ঘ ইতি টেনে প্রবাসে যান তার মনের অবস্থা মনে হয় একজন জীবন্ত লাশের মতো।
হরতাল দেশের মানুষের প্রতিমুহূর্তের এক অভিশাপ বঙ্গদেশে। বিরোধী দলগুলো এক প্রকার তৃতীয় লিঙ্গের চেয়েও অধম এখন… কিছুই করার ক্ষমতা নেই এদের। কারণ এরা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হয় আন্দোলনে। ক্ষমতা নেই এদের তবু রং মেখে সং সাজবে এরা।
মানুষ পোড়ানো, ভাংচুর দিয়ে কি আর ক্ষমতায় যাওয়া যায়। প্রেস ব্রিফিং দিয়ে আর হুমকি ধামকিতে ক্ষমতায় যাওয়া যায়, যে সরকার আসুক যে যায় লংকায় সে হয় রাবণ। যাদের রেমিট্যান্সে সচল দেশের চাকা এদের জন্য ন্যূনতম নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই, কেউ দিতে পারেও না।
২০১৩ সালে বাড়ি থেকে, বউ বাচ্চাদের নিয়ে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় এলাম, আমার মেয়েরা আমাকে বিদায় দিবে বিমানবন্দরে। বোনের বাসায় উঠলাম। কেনাকাটা করেছি উত্তরায়, বাসায় ফিরতেই বোন ভগ্নিপতি ছোট ভাই পেরেশান, বলছে অনির্দিষ্টকালের হরতাল কাল থেকে। এদিকে মেয়ের পরীক্ষা। ঘড়িতে রাত ১০টা। রাতেই ফিরতে হবে নোয়াখালী। শুরু হলো চারদিকে যোগাযোগ।
বোনের কান্না বাচ্চাদের কান্নার রোল, রাতে বসে সবাই এক টেবিলে খাবে, আমার মেয়ে দুটিকে আমার বোন ভগ্নিপতি অনেক আদর করে। ওরা ঢাকা আসবে শুনলে ওদের পছন্দের বাজার শুরু হয়ে যায়। সেবার আমার বউয়ের নাকি কোন এক খাবার খেতে মন চেয়েছে তাও রান্না করেছে আমার আদরের বোন। কিন্তু এখন একটাই চিন্তা বউ-বাচ্চাদের দেশে পাঠাতে হবে, ভোর থেকে হরতাল। ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে ছোট ভাই মাছুমের বন্ধু ফরহাদ শ্যামলী গেল, টিকিট ম্যানেজ করল, একদল পিজি শাহবাগের মোড়ে মোটরসাইকেলসহ অপেক্ষায়, আমরা উত্তরা থেকে সিএনজি নিয়ে পিজির সামনে গেলাম। বড় মেয়ে অভিমানী, অভিশাপ দিচ্ছিল হরতালকারীদের। ছোট মেয়ের কান্না, বউ আমার চুল আর জামার বেহাল অবস্থা করেছে সিএনজিতে কেঁদে। বাসায় বোন তো ডাইনিং টেবিলেই কান্না, এত রান্না এত আয়োজন বাচ্চারা কিছুই খেতে পারল না। পিজির সামনে থেকে প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে ওদের মাছুম নিয়ে গেল দেশে। সকালে আমি ফিরে এলাম প্রবাসে। মনের কি অবস্থা এতক্ষণে আন্দাজ করেছেন নিশ্চয়ই। ২০১৪ সালে আল্লাহর বিশেষ রহমত। বাচ্চারা আসল আমার সঙ্গে, পরিবার সকালে আমার সঙ্গে বিমানবন্দর যাবে, আমি আসব প্রবাসে, ওরা যাবে বিমানবন্দর থেকে দেশে, রাতে উত্তরায় বন্ধু রিপনের অফিসে আমি দেখা করতে গেছি, সঙ্গে অনেক পুরনো বন্ধু টফির সঙ্গে প্রায় পঁচিশ বছর পর দেখা। রাশেদ, আবুসহ অনেকেই এক সঙ্গে চা নাস্তা খাব, গল্প করব, হঠাৎ খবর পেলাম সকাল থেকে হরতাল। চলে এলাম অসমাপ্ত আড্ডা রেখে। একদিন পর আমার মেয়ের হাই স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা। এবার বউ আর গেল না, মেয়েকে পাঠিয়েদিলাম ওর চাচার সঙ্গে, ফেসবুক আপডেটে মেয়ের ছবি দেখে রাত কাটিয়েছি। মেয়ে আগেরবার অভিশাপ দিয়েছিল হরতালকারীদের, এবার বলেছে আব্বু আমার সঙ্গেই কেন এমন হয়, তোমার সঙ্গে কেন এমন হয়, ওরা কি করে জানে তুমি চলে যাবে, আমরা বিমানবন্দর যাব, ওরা হরতাল দিয়ে তোমাকে কেন কষ্ট দেয়, আমাদের এত কষ্ট দেয়। আব্বু তুমি মনে কষ্ট নিও না, আমি ঠিক আছি, চোখ বড় করে আমার সামনে এসে বলে দেখো চোখে একটুও পানি নেই। ভাই মাছুম আমার মেয়ে দেশে রেখে আবার আমার সঙ্গে বিমানবন্দর এসে দেখা করেছে। আর বউ ছোট মেয়েকে নিয়ে পরে ফিরেছে বাবা-মায়ের কাছে।
নিজের দুটি ঘটনার উদাহরণ দিলাম, বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার হাজার লক্ষ মানুষের দুর্ভোগের সঙ্গে প্রবাসীদের আসা-যাওয়ার কষ্টগুলো কোনো দল ভেবে দেখে না। একটা ফ্লাইট মিস হলে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, ভিসার মেয়াদ শেষ হতে পারে, চাকরি হারাতে পারে।
সেই যা হোক এত কাহিনি বাস্তবতার উদাহরণ দেওয়ার একই অর্থ প্রবাসীদের জীবন যেন বিড়ম্বনার কারখানা, কারখানায় প্লান করে তৈরি হয় কিন্তু এখানে প্রাকৃতিক কৃত্রিম দুইভাবেই তৈরি হয়। কেন যে এমন হয়, তবে এর কারণ একটাই গ্যাপ-দূরত্ব। একে অপরকে না বোঝার সমস্যা। কাছাকাছি থাকলে সুখে-দুঃখে এক সঙ্গে থাকা যায়, দূরে গেলে প্রেম-ভালোবাসা আদর শ্রদ্ধা ভক্তি সব পানসা হয়ে যায়। সম্পর্ক হয়ে পড়ে শুধু অর্থনৈতিক।
এই লেখা কাউকে ইঙ্গিত করে নয়, নিজের ও কয়েকজন প্রবাসীর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার আধার।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বাবু, সিঙ্গাপুর থেকে