১৯৬৭ সাল। হাভার্ড ইউনিভার্সিটিতে বক্তব্য দিতে এসেছেন এক নবীন রাষ্ট্রের নবীন রাষ্ট্রনায়ক। নাম তার লি কুয়ান ইউ। তিনি কথা বলেছিলেন, তত্কালীন ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে। তার বক্তব্যটি এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, পরদিন ক্রিমসন ইউনিভার্সিটির প্রকাশিত সংবাদপত্রে বলা হয়েছিল, ‘নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ একদিন শুধু তার দেশের নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের গুটিকয়েক রাষ্ট্রনায়কের একজন হবেন, যারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে স্বদেশের উন্নতি ঘটাতে পারবেন। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাই তাকে একজন শক্তিশালী আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে গড়ে তুলবে।’
এই মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে আরও বেশ কিছুদিন আগেই। পাঁচ দশক আগে মন্তব্যটি অনেকের কাছে বাগাড়ম্বর মনে হলেও আজ লি কুয়ান ইউ’র প্রয়াণের পর তা সকলেই মেনে নিচ্ছেন দ্বিধাহীনভাবে। কারণ তিনি তৃতীয় বিশ্বের একটি নগররাষ্ট্রকে তুলে এনেছেন প্রথম বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের তালিকায়। তার জাদুস্পর্শেই সিঙ্গাপুর এখন বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। সিঙ্গাপুরের জনগণের কাছে লি কুয়ান ইউ শুধুমাত্র প্রথম প্রধানমন্ত্রী নন, একই সঙ্গে তাদের স্বপ্নকে সত্যি করার জাদুকর।
১৯৫০ এর দশক ছিল এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার সময়কাল। সেসময় বিশ্বে জওহরলাল নেহরু বা গামাল আবদেল নাসেররা যেভাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন, ততটা পরিচিত ছিলেন না লি কুয়ান। ১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর মালয়েশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সিঙ্গাপুর। কিন্তু সেই জোট থেকে বের হয়ে ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় সিঙ্গাপুর। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই দেশটির হাল ধরেছিলেন লি কুয়ান ইউ। সদ্য উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়া একটি দেশের যেসব সমস্যা থাকার কথা, তা থেকে ব্যতিক্রম ছিল না সিঙ্গাপুরও। দায়িত্ব নিয়েই লি কুয়ান বুঝেছিলেন দেশের উন্নয়ন করতে হলে রাজনৈতিক স্থিরতা থাকা প্রয়োজন। আর তাই আদর্শ ও উপলব্ধ বাস্তবতার মিশেল ঘটিয়েছিলেন তিনি। তার রূপায়ন তিনি করেছিলেন সরকারি নানা নীতিতে।
এ প্রসঙ্গে সিঙ্গাপুরের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বিলাহারি কৌসিকান বলেন, ‘তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আর্ন্তজাতিক আইন মেনে চলা প্রয়োজন। এটিই আপনাকে নিয়ে যাবে সেই স্তরে। সুতরাং রাষ্ট্রনায়ককে অবশ্যই বাস্তবতার নিরিখে পথ চলতে হবে। তাকে বুঝতে হবে যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে না। তবে তা অবশ্যই কিছু প্রাথমিক নীতি মেনে চলবে। এটির সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন লি কুয়ান ইউ। আর তাই তার নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর আজ বিশ্বের ধনী ও উন্নত দেশগুলোর কাতারে উঠে এসেছে।’
লি কুয়ান কিন্তু তাই বলে আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সবসময় সমঝোতা করে চলেননি। যখন প্রয়োজন মনে হয়েছে, তখন তিনি ইস্পাত কঠিন চরিত্রের এক রাষ্ট্রনায়ক। ১৯৭১ সালে সিঙ্গাপুর থেকে ব্রিটিশ বাহিনীর সামরিক ঘাঁটি প্রত্যাহারের ঘটনাতেই তা প্রমাণিত হয়। সেক্ষেত্রে নিজ দেশের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তাকেই তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
লি কুয়ান ইউ’র পররাষ্ট্রনীতি ছিল সিঙ্গাপুরের উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি। তিনি একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের বন্ধু বানিয়েছেন, অন্যদিকে অর্জন করেছিলেন এশিয়ার শক্তিধর রাষ্ট্র চীনের বিশ্বাস। এ দুই বিপরীত মেরুর দেশের মধ্যে তিনি হয়েছিলেন সম্পর্কের সেতুবন্ধন। শুধু সামরিকভাবে নয়, এই দুই দেশ সিঙ্গাপুরকে সহযোগিতা করেছিল বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভূমিকা রেখে। আর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে বন্ধু বানিয়ে তার ভিত্তি রচনা করেছিল লি কুয়ান ইউ’র সফল কূটনীতি।
২০০৯ সালে দেয়া এক বক্তব্যে লি কুয়ান বলেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বন্ধুত্ব তৈরিতে আপনার দেশের সুনাম বা রাষ্ট্রনায়কের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব রাখে না। বন্ধুত্ব করতে হলে আপনার দেশ যে অন্যের কাছে প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়- তা আপনাকে প্রমাণ করতে হবে। এজন্য প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। তবেই আন্তর্জাতিকভাবে একটি দেশ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। তখন অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র তাদের প্রয়োজনের খাতিরেই আপনার বন্ধু হয়ে উঠবে।’
লি কুয়ান ইউ ১৯৫৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তবে তিনি ২০১১ সাল পর্যন্ত সরকারের হয়ে কাজ করে গেছেন। তিনি সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করে তুলেছিলেন এবং এর আধুনিকায়ন সম্পন্ন করেছিলেন। তবে তার আমলের কঠোর শাসনব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনাও আছে। সিঙ্গাপুরে তার বিরোধী মতের রাজনীতিকদের তিনি দমন করেছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়ে থাকে। লি কুয়ান রাজনৈতিক স্থিরতা ও ক্ষমতার রদবদলজনিত অস্থিরতা ঠেকাতে চেয়েছিলেন। তার গৃহীত নীতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য সেটি দরকারও ছিল। কিন্তু তা নিশ্চিত করতে গিয়ে অনেকাংশেই বিরোধীদের কার্যত দমন করেছিলেন তিনি। ১৯৫৯ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনেই জয়ী হয়ে আসছে লি কুয়ানের প্রতিষ্ঠা করা রাজনৈতিক দল দি পিপলস অ্যাকশন পার্টি (পিএপি)। বর্তমানেও পার্লামেন্টের ৮৭টি আসনের মধ্যে ৮০টিই এর দখলে।
তবে লি কুয়ানের কৃতিত্বকে কিন্তু খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মাত্র ২৭৭ বর্গমাইলের একটি ছোট্ট দেশকে তিনি এনে দিয়েছেন বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তির স্বীকৃতি। অসুস্থ হওয়ার আগে দেয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাত্কারে তাই বলতে পেরেছিলেন, ‘স্বাধীনতা লাভের সময় আমাদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় কিছুই ছিল না। কিন্তু আজ আমরা এ অবস্থায় এসেছি। ইতিহাস বেশ লম্বা একটি সময়। আর আমি বোধহয় আমার ভূমিকাটি ঠিকভাবেই পালন করতে পেরেছি।’