চট্টগ্রাম বিভাগীয় ও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে বাংলাদেশী হিসেবে পাসপোর্ট পাচ্ছে রোহিঙ্গারা। যেখানে প্রকৃত বাংলাদেশীদের পাসপোর্ট পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, সেখানে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট পাচ্ছে। তাদের একটি বড় অংশের হাতে উৎকোচের বিনিময়ে পাসপোর্ট পৌঁছে যাওয়ার ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এতে করে পাসপোর্ট গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট সরবরাহ চক্রের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) কিছু অসাধু সদস্য এবং অর্ধশতাধিক দালালের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত। একজন রোহিঙ্গা পাসপোর্ট পেতে দালাল চক্রকে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা দেয়। এর মধ্যে পুলিশ তদন্ত রিপোর্টের জন্য ৭ হাজার, পাসপোর্ট অফিসকে ৮ হাজার, চেয়ারম্যান সনদের জন্য ২ হাজার টাকা দিতে হয়। বাকি টাকা সংশ্লিষ্ট দালাল পেয়ে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, দুর্বল পুলিশ ভেরিফিকেশন, সত্যায়নকারীর অসাধুতা ও অবহেলা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, পাসপোর্ট অফিস ঘিরে গড়ে ওঠা দালাল চক্রের সহায়তা, প্রকৃত রোহিঙ্গা চিহ্নিতকরণ জরিপ না করা এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি কিছু রাজনৈতিক দলের সমর্থনের কারণে তারা পাসপোর্ট পাচ্ছে। গত ৫ বছরে চট্টগ্রামের পাসপোর্ট অফিস থেকে বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশী নাগরিক সেজে পাসপোর্ট হাতিয়ে নিয়ে অর্ধলাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে। তাদের অধিকাংশ গেছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। শুধু সৌদি আরবেই বর্তমানে কমপক্ষে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। তারা সৌদি আরবে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ কর্মকা-ে। জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের বিদেশে যেতে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান মুভমেন্ট, আরাকান পিপলস ফ্রিডম পার্টি, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (এআরএনও) নেতারা।
এদিকে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পেতে সহায়তাকারী দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০১২ সালে সংশ্লিষ্ট দফতরে গোপন প্রতিবেদন দেয় সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসের ৬৫ দালালের নাম উল্লেখ করা হয়। তালিকাভুক্ত এসব দালাল হলো শামসুদ্দিন চৌধুরী, হাজী সফি, ইউনুছ, আবদুল মন্নান, মিলন মেহেদী, হাজী ফয়েজ, নারায়ণ দেব, আবদুর রশিদ, নাজিম উদ্দিন, আবুল মনসুর, এম ফারুক, জাহাঙ্গীর হোসেন, চন্দ্রশেখর রায়, লক্ষ্মণ চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, রাসেল আহমেদ, আহম্মদ হোসেন, উজ্জ্বল দত্ত, ইউনুছ চৌধুরী, রায়হান চৌধুরী, শফিকুল আলম, কানু চৌধুরী, ইয়াছিন চৌধুরী, অমলেন্দু বিকাশ দত্ত, আলী রেজা, অজিত কুমার আইচ, সেকান্দর হোসাইন, রফিকুল ইসলাম, সৈয়দ মিয়া, ধীমান কুমার মুহরী, নওয়াব হোসাইন, শাহাব উদ্দিন, তাজুল ইসলাম, একরামুল হক জুয়েল, ইব্রাহীম, আলমগীর, পীযূষ, মিলন মুখার্জি, আবদুল করিম বাদশা, মাহমুদুল হক, সুশীল কুমার সরকার, তুষার পাল, সমীউদ্দিন, দিদারুল আলম, হারুনুর রশিদ, জাকের হোসাইন, শাহ আলম, ছাবের আহমদ, ইসকান্দর, দিলীপ চৌধুরী, প্রণব ভট্টাচার্য, আবদুল মনাফ, জালাল উদ্দিন, শাহেদুল ইসলাম, মঈনুল ইসলাম, আশীষ বিশ্বাস, জাহাঙ্গীর আলম, মহসিন, সিরাজ, নেয়ামত উল্লাহ, কামাল উদ্দিন, জয়নাল আবেদীন ও মনজুর আলম। ২০১২ সালের জুনে প্রকাশিত এ তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। এসব সিন্ডিকেটের তৎপরতায় এক মাসের মধ্যেই রোহিঙ্গারা পেয়ে যায় বাংলাদেশী পাসপোর্ট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাভেল এজেন্সির এক মালিক বলেন, ২০১২ সালে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট প্রকাশের পর দালালরা আড়ালে চলে গিয়েছিল। বর্তমানে তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করে দেয়ার পাশাপাশি প্রকৃত বাংলাদেশীদের কাছ থেকেও দালালরা অবৈধ টাকা নিচ্ছে। এ টাকা না দিলে সঠিক সময়ে পাসপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে প্রায় সবাই সরকারি হিসাবের বাইরে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা বেশি দিচ্ছে। দেশের স্বার্থে এ অবস্থার অবসান প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশের হাতে উৎকোচের বিনিময়ে পাসপোর্ট পৌঁছে যাওয়া দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এ ধরনের অভিযোগগুলো যথাযথভাবে তদন্ত হওয়া উচিত এবং পাসপোর্টদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
এদিকে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক ফজলুল হক বলেন, পাসপোর্ট দেয়ার আগে পুলিশি তদন্ত পর্যালোচনা করা হয়। পুলিশি তদন্তে কারও বিরুদ্ধে নেতিবাচক রিপোর্ট থাকলে তাকে পাসপোর্ট দেয়া হয় না। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাঈমুল হাছান বলেন, পাসপোর্ট তদন্তের জন্য জেলা গোয়েন্দা শাখায় আবেদনগুলো যথাযথভাবে তদন্ত করা হয়। দালাল বা রোহিঙ্গার কাছ থেকে টাকা নিয়ে পক্ষে রিপোর্ট দেয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। আলোকিত বাংলাদেশ।