নির্বাচন-পরবর্তী প্রায় এক বছর নিজস্ব কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও রাজনীতির টানাপোড়েনে এবার সাংঘর্ষিক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লন্ডনে বসে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিতর্কিত মন্তব্যকে কেন্দ্র করেই মূলত দুটি সংগঠন এখন মারমুখী অবস্থানে রয়েছে।
গত কয়েক দিন ধরেই সংগঠন দুটির নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আর হুমকি-ধমকিতে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। ছাত্রলীগ বলছে, তারেক রহমান তার বক্তব্যের জন্য ক্ষমা না চাইলে এবং তাকে দল থেকে বহিষ্কার না করা হলে ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরে বিএনপির পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। এ দাবিতে সেখানে পাল্টা সমাবেশের ডাক দিয়েছে সংগঠনটি।
অন্যদিকে ছাত্রলীগের হুমকি উড়িয়ে দিয়ে গাজীপুরে খালেদা জিয়ার সমাবেশ আয়োজনের দায়িত্ব নিয়েছে ছাত্রদল। সংগঠনটি বলেছে, গাজীপুরসহ সারা দেশে সমাবেশ প্রতিহত করার ঘোষণার পরিণাম কী ভয়াবহ হবে তা ছাত্রলীগ হাড়ে হাড়ে টের পাবে। ‘কুরুচিপূর্ণ’ বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিঃশর্ত ক্ষমা না চাইলে ছাত্রলীগকে ‘গণধোলাই’ দেওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছে ছাত্রদল। এ পরিস্থিতিতে যেকোনো সময় সংগঠন দুটির মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেশ কয়েকটি ‘বিতর্কিত’ মন্তব্যের পর বিজয় দিবস উপলক্ষে গত ১৫ ডিসেম্বর লন্ডনে বিএনপি আয়োজিত এক আলোচনাসভায় বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজাকার’ বলেন তারেক রহমান।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিব এখন আওয়ামী লীগের লালসালু। এই লালসালুকে ঘিরে থাকা ভণ্ডরাই নিজেদের স্বার্থে যাকে-তাকে রাজাকার আখ্যা দেয়। আওয়ামী লীগ নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের দল দাবি করে, অথচ চোরের দল, চাটার দল আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিব নিজেই আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এমন একটি কাজ করার জন্য তাহলে তো শেখ মুজিবই বড় রাজাকার।’
তারেক রহমান বলেন, ‘বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকালীন দল বটে, তবে মুক্তিযুদ্ধের দল নয়। এ দলের অধিকাংশ নেতাই মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশ নেননি।’
তারেক দাবি করেন, বঙ্গবন্ধু যদি ৭ মার্চ সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসারদের নিয়ে যুদ্ধ শুরু করতেন, তাহলে যে ‘সামান্য সংখ্যক’ পাকিস্তানি সৈন্য তখন ছিল, তাদের সহজেই পরাজিত করা যেত; প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক কমানো যেত। বঙ্গবন্ধু ‘পাকবন্ধু’ ছিলেন বলেই এমনটি করেননি।
বঙ্গবন্ধুকে ‘শখের বন্দি’ আখ্যায়িত করে তারেক আরো দাবি করেন, যুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর আঁতাত ছিল।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ছয় বছর ধরে প্রবাসে থাকা তারেক রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবার এবং স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে এর আগেও বিতর্কিত মন্তব্য করে বেশ কয়েকটি মানহানির মামলার আসামি হয়েছেন। তারেক দাবি করেছেন, তার বক্তব্য ছিল ‘অপপ্রচারের’ জবাব। তার ওই বক্তব্যের পর এ পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় দুই ডজন মামলা হয়েছে। আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছেন কয়েকটি মামলায়।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তারেক রহমানের ওই বক্তব্যের পর দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিশেষ করে, তার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতারা কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য তারেক রহমানকে ‘অশিক্ষিত জানোয়ার’ বলেও আখ্যায়িত করেন দলটির প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তারেক রহমানের জিভ সামলাতে তার মা খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘লেখাপড়া শেখেনি, জানোয়ারের মতো কথা বলে। জানোয়ারের শিক্ষা কীভাবে দিতে হয়, মানুষ তা জানে। মানুষের কাছ থেকে জানোয়ার যে শিক্ষা পায়, তা-ই দেওয়া উচিত এবং মানুষ তা দেবেও।’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ রোববার গাজীপুর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তির জন্য তারেক রহমান ক্ষমা না চাইলে বা দল থেকে বহিষ্কৃত করা না হলে ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জনসভা প্রতিহত করা হবে। একই সঙ্গে ওই দিন একই মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়।
ছাত্রলীগের এই ধরনের বক্তব্যের পর তাদের প্রতিহত করার হুঁশিয়ারি দেয় বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ওই দিনই গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনটির সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক মো. আকরামুল হাসান বলেন, ‘ছাত্রলীগকে সাবধান হয়ে নিজেদের কুকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যথায় ছাত্রদল আগের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এ ধরনের সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করবে।’
একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সাম্প্রতি তারেক রহমানের দেওয়া ‘বিতর্কিত’ বক্তব্য প্রত্যাহারের পরিবর্তে ভবিষ্যতে আরো ‘তথ্যভিত্তিক বক্তব্য’ জাতির সামনে নিয়ে আসবেন মন্তব্য করে পরিস্থিতি আরো উসকে দেন ছাত্রদলের নেতারা।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান বলেন, ‘খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান সম্পর্কে সব কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে হবে, তা না হলে ছাত্রসমাজকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং রাজপথে গণধোলাই দিয়ে ছাত্রলীগকে রাজনৈতিক শিষ্টাচার শেখানো হবে।’
ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলনের প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপারাজেয় বাংলার পাদদেশে ছাত্রলীগের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে গাজীপুরে খালেদা জিয়ার সমাবেশ প্রতিহত করা হবে। এ ছাড়া তারেক রহমান কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের জন্য যত দিন ক্ষমা না চাইবে তত দিন বিএনপিকে দেশের কোথাও কোনো সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্রদল যে মন্তব্য করেছে, সে ধরনের অশালীন শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। ছাত্রদল হয়তো ভুলে গেছে, যে শব্দ উচ্চারণ করেছে তার সমুচিত জবাব তারা অতীতে পেয়েছে। আমি ইতিহাস থেকে তাদের শিক্ষা নিতে বলব।’
২৭ ডিসেম্বর ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠে ২০ দলীয় জোটের জনসভায় খালেদা জিয়ার প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখার কথা রয়েছে।
ছাত্রলীগের সমাবেশ প্রতিহত করার ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী ছাইয়্যেদুল আলম বাবুল বলেন, ‘জনসভা আমাদের রাজনৈতিক অধিকার। আমি আশাবাদী, দেশের অন্যান্য জেলার মতো আগামী ২৭ ডিসেম্বরে গাজীপুরেও জনসভা সফল হবে।’
এ বিষয়ে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপি চায়, ২৭ ডিসেম্বর শোডাউন করবে। অন্যদিকে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে বিএনপিকে জনসভা করতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রলীগও। একই দিন শোডাউনের ঘোষণা দিয়েছে তারা। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা-পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জনসভার প্রস্তুতি জানতে এবং ছাত্রলীগের প্রতিহত করার ঘোষণার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলন বলেন, ‘সমাবেশের জন্য প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি নেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগ অগণতান্ত্রিক ও অবৈধভাবে জনসভার প্রতিহত করতে চাচ্ছে। গাজীপুর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্বশীল জেলা। সুতরাং তারা ছাত্রলীগকে বিরত রাখতে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবেন বলে বিশ্বাস করি।’
তিনি বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে সমাবেশ করা হবে। এটি আমাদের নৈতিক অধিকার। যদি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ব্যাহত করতে পায়ে পাড়া দিয়ে অন্য কর্মসূচি দিতে বাধ্য করে, তা কারো জন্যই ভালো হবে না।’ সমাবেশে বাধা সৃষ্টি না করে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার জন্য আওয়ামী লীগ ও প্রশাসননের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। জনসভায় কমপক্ষে ১০ লাখ লোকের সমাগম হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন বিএনপির এই নেতা।