সুন্দরবনে ট্যাংকারডুবির ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া তেল তাম্বুলবুনিয়া পেরিয়ে কটকা কচিখালী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এই জায়গাটি বনের রাজা বেঙ্গল টাইগারের বিচরণক্ষেত্র। তেল ছড়িয়ে পড়া বন্ধে গতকাল পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে করণীয় ঠিক করতে একমতও হতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেল অপসারণে চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে করে বয়ে নিয়ে আসা ‘অয়েল স্পিল ডিসপারসেন্ট’-এর ব্যবহার সুন্দরবনে প্রাণীদের জন্য নতুন করে হুমকি তৈরি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাসায়নিক পদার্থ না ছড়িয়ে বরং তেল ছড়িয়ে পড়া বন্ধে আক্রান্ত এলাকার চারপাশে দুই থেকে তিন স্তরে রাবারের তৈরি বিশেষ বুম (এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা, যা তেল ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে পারে) বিছিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। আর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় স্থানীয় জনগণের মাধ্যমে খালি হাত বা ফোমের সাহায্যে তেল অপসারণের চেষ্টা থেকে বিরত থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা উচিত বলে মন্তব্য তাঁদের।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান ভুইয়া প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় জনগণকে দিয়ে এই তেল পুরোপুরি অপসারণ করা সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞরা দ্বিমত করলে রাসায়নিক পদার্থ ছিটিয়েও তেল অপসারণ করা ঠিক হবে না। তেল অপসারণের বিষয়টি স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসনের ওপর ছেড়ে না দিয়ে একে একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সহায়তা নিতে হবে।
এদিকে দুই দিন ধরে একের পর এক সভা করেও তেল অপসারণে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগকে রাজি করাতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এ দুটি প্রতিষ্ঠান ওই রাসায়নিক ইতিমধ্যে নিজেদের গবেষণাগারে পরীক্ষা করেছে এবং এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করেছে। কিন্তু কোনো পর্যায় থেকেই এ রাসায়নিক ব্যবহারের ব্যাপারে সম্মতি মেলেনি।
বড় বনে বড় বিপর্যয়
পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন, সচিব নজিবুর রহমান ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রইছউল আলম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে পেরুর লিমায় রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এই রাসায়নিকের ব্যবহারে অনুমতি দেওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইছে না বলে জানা গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. শাজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই রাসায়নিক পদার্থের নমুনা বুয়েট এবং আমাদের নিজস্ব গবেষণাগারে পরীক্ষা করেছি। কোথাও থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আসেনি। তাই সুন্দরবনে এর ব্যবহারের অনুমোদন দিতে পারছি না। তবে বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞই এ পরিস্থিতিতে রাসায়নিক ব্যবহার করে তেল নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ইতিবাচক মত দেননি। তাই আমরা আরও যাচাই-বাছাই করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি বিশেষজ্ঞ দল সুন্দরবনের মাটি-পানি পরীক্ষা করতে সুন্দরবনে আসছে। দলটি তেল নিঃসরণের ফলে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ব্যবস্থা কী ক্ষতি হয়েছে, তা বোঝার চেষ্টা করবে।
কালো তেলে কাঁকড়া বিপন্ন, কুমিরের দেখা নেই
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজের পরিচালক অধ্যাপক শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের তেল ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরামর্শক হিসেবেও কাজ করছেন। সুন্দরবনে এখন পর্যন্ত যেসব এলাকায় তেল ছড়ায়নি, সে এলাকাগুলোকে রক্ষার জন্য তিন স্তরে রাবারের তৈরি বিশেষ বুম বিছিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
মুঠোফোনে প্রথম আলোকে শাহাদাত হোসেন বলেন, শ্বাসমূলীয় বন অতি সংবেদনশীল এলাকা। এখানে যেকোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহারেই জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই বুম দিয়ে এগুলোতে আটকে আস্তে আস্তে জড়ো করে তারপর তেল অপসারণ করতে হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সুন্দরবনবিষয়ক গবেষক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, ছড়িয়ে পড়া তেলের কারণে আক্রান্ত এলাকার ছোট গাছ ও লতাগুল্মগুলো মারা যাবে। কীটপতঙ্গ, ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো আক্রান্ত হবে সবার আগে। কিন্তু কিছু কৌশল অবলম্বন করলে ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য ছোট ছোট নৌকার মাধ্যমে বনের বিভিন্ন কোনায় জমে থাকা তেলগুলো অপসারণ করতে হবে। বনের কাদাগুলো পরীক্ষা করে দেখতে হবে কতটুকু পর্যন্ত তেল প্রবেশ করেছে।
কাদার ওপরের স্তরটি যেভাবেই হোক অপসারণ করে অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। নয়তো কাদার ওপরে নির্ভরশীল মাছ ও অন্যান্য প্রাণী ধীরে ধীরে মারা যাবে। শ্বাসমূলগুলোতে লেগে থাকা তেল অপসারণে আগামী বর্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। রাসায়নিক ছিটিয়ে তেল অপসারণ করতে গিয়ে তেলের চেয়েও বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।