বাংলাদেশের ৮০ লাখেরও বেশি লোক বিদেশে অবস্থান করছে এবং বিভিন্ন পেশায় জড়িত রয়েছে। পৃথিবীর ২২০টি দেশে বসবাস করা এসব প্রবাসীর মধ্যে হাজার হাজার লোক রয়েছেন যারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের চিন্তা-ভাবনা করছেন। হাজারের ওপর লোক আছে যারা এসব দেশে বাস করছে, কিন্তু থাকার চিন্তাভাবনা বিবেচনায় রেখেছে। হাজারো লোক আছেন যারা বিদেশে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রটাতে বিশাল এক সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রতিদিনই বন্ধু কিংবা স্বজনদের মাধ্যমে আমরা শুনতে পাচ্ছি, যার বিদেশে গেছেন তাদের কেউ গ্রিন কার্ড পেয়েছেন কিংবা নাগরিকত্ব পেয়েছেন। নাগরিকত্ব পাওয়াদের অধিকাংশই তাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ধরে রাখেন, যাতে করে নিজের মাতৃভূমিতে ফিরতে পারেন কিংবা চিরনিদ্রায় শায়িত হতে পারেন। এটাকে স্মৃতিকাতরতাই বলেন অথবা দেশপ্রেম বলেন, তবে বিদেশের একটা প্রভাব থেকেই যায়। কেননা জীবনের একটা ভালো সময় তারা বিদেশে কাটাচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের তারা চানই বিদেশের নাগরিকত্ব দিতে। লোকদের এ অভিবাসন বাংলাদেশে নতুন নয়। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মিয়ানমার এবং আফগানিস্তানের লোকেদেরও একটি অংশ বিশাল হারে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারাই বিদেশে নাগরিকত্ব চাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই এজন্য আমেরিকাকে পছন্দ করছেন। আর সেখানে না পারলে কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়াকে তারা বেছে নেন। একটা সময় ছিল মানুষ খুব বেশি বৃটেন যেত এবং সেখানে নাগরিকত্ব নিতো। ১৯৫০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মানুষ বৃটেনের ভিসার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ত।
তথ্যমতে, অভিবাসন নিয়মে কঠোরতা সত্ত্বেও অধিকাংশ প্রবাসীর পছন্দ আমেরিকা। বিলাসবুহল জীবনযাত্রা, চিকিৎসা, শিক্ষা ও আবাসনের সুবিধার জন্য আমেরিকা ও কানাডাকে পছন্দ করেন প্রবাসীরা।
বসবাসের জন্য আমেরিকাই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা জায়গা নয়। তথ্য-প্রমাণ এটা বলে না যে, আমেরিকাই বসবাসের সেরা জায়গা।
‘আমেরিকা কেন এক নাম্বার’ আমেরিকানদের এ প্রশ্ন করলে তারা বলবে, “আমাদের এখানে সবকিছুর স্বাধীনতা আছে, যেটা অন্য কোনো দেশে পাবেন না।” তারা এটাও বলবে, “খুব সহজে চাইলেই আপনি এখানে ব্যবসা শুরু করতে পারেন।” এটা সত্য। তবে আমেরিকায় অধিকাংশ ব্যবসাই নিয়ন্ত্রণ হয় না, অনেককে ক্ষেত্রে সরকারের প্যাঁচেও পড়তে হতে পারে আপনাকে।
আমেরিকা এখনো একটি বড় জাতি। তাদের রয়েছে শক্তিশালী সেনা-বাহিনী। জনসংখ্যার আধিক্য সত্ত্বেও দেশটির বিশাল অর্থনীতি রয়েছে। পদ্ধতিগত কিছু দুর্নীতি থাকলেও দেশটিতে গড়ে দুর্নীতি খুবই কম হয়। কিছু কিছু লোকের ধারণা আমেরিকার ওপর আর কোনো দেশ হয় না।
ডেনমার্ক এবং নরওয়েও খুব ভালো দেশ। তবে আমেরিকার ১৫১টা বড় শহর রয়েছে যেখানে জীবনযাত্রার উচ্চমান, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও অন্যান্য সুবিধা রয়েছে। দেশটির রয়েছে আধুনিক শহর, সুন্দর উপশহর। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতির একত্রিত মেলবন্দন।
আমেরিকাই প্রথম প্রকৃত গণতন্ত্র, কম্পিউটার, বিমান, টেলিভিশন, চাঁদে অবতরণ, সেরা ছবি ও সংগীতের সঙ্গে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দেয়। চীনের শিশুরা খুবই চঞ্চল। বিলাসবহুল জীবনের আরো অনেক দেশ আছে। কিন্তু সবকিছুর সেরা সমন্বয় আমেরিকাতেই ঘটেছে।
এতকিছুর পরও আমেরিকায় বসবাসে কিছু দুশ্চিন্তা রয়েছে, কিন্তু কেন? ছয়টি গুরত্বপূর্ণ দিক বিবেচনায় আমেরিকায় বিশ্বের তিন নম্বর দেশ।
প্রথমত, অস্ত্র দিয়ে যতগুলো খুনের ঘটনা ঘটে, তার নেতৃত্বদানকারী দেশ হিসেবে উঠে আসে আমেরিকার নাম। উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় গড়ে ২০টি বেশি খুনের ঘটনা ঘটে এ দেশটিতে।
দ্বিতীয়ত, আমেরিকার সন্ত্রাস দমন বিচারব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। গবেষণায় জানা যায়, দেশটির এক লাখ লোকের মধ্যে গড়ে ৭১৬ জন কারাবন্দী রয়েছে। আর এ জায়গায় রাশিয়ায় ৪৮৪, চীনে ১২১ এবং ইরানে ২৮৪ জন কারাবন্দী রয়েছে। আমেরিকা, বাংলাদেশের মতোই কারাবন্দীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে।
তৃতীয়ত, অপর এক গবেষণায় জানা গেছে, আমেরিকার দক্ষিণে জীবনযাত্রার মান আলজেরিয়া, নিকারাগুয়া এমনকি বাংলাদেশের চাইতেও নিম্নমানের। উন্নত দেশের মধ্যে আমেরিকাই ব্যতিক্রম দেশটি সব নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা দেয় না। অন্যান্য তুলনীয় দেশের তুলনায় আমেরিকায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের নৈতিক স্খলন বেশি। দেশটির তরুণীদের অনৈতিক গর্ভপাতের ঘটনাও অন্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি।
চতুর্থত, আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় কাঠামোগত বৈষম্য রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের চাইতে স্থানীয়দের অর্থায়নে বেশির ভাগ স্কুল তৈরি হয়। আমেরিকার শিক্ষার শতকরা ৪০ ভাগ অর্থায়ন জনগণের দ্বারা হয়ে থাকে। যার দরুণ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায়ও আমেরিকার টিউশন ফি বেশি।
পঞ্চমত, সেবার জন্য অন্যান্য উন্নয়শীল দেশের চাইতেও কৃপণ স্বভাবের দেশ আমেরিকা। আর এ জন্য এর সমাজ ব্যবস্থার বৈষম্যের চাপ দেখা যায়। বৈষম্য গনতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সমাজ কষ্টকে প্রকট করে।
ষষ্ঠত, দেশটির আবাসন ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। খুব দ্রুত এটার সংস্কার প্রয়োজন। আগামী ছয় বছরে এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে ৩.৬ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। আন্তর্জাতিক আবাসন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে খুব সহজেই দেশটির অবনতি চোখে পড়ে।
এটা খুবই বুদ্ধিমানের কাজ হবে যে, এখন থেকে আমেরিকায় স্থায়ী হওয়ার আগে একটু ভাবনা-চিন্তা করে নেয়া। আগামী দশকে বুদ্ধিমানদের একটু ভেবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সূত্র: ডেইলি স্টার।