Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

humayun kabirএখনও পাঠশালায় যান যশোরের জেলা প্রশাসক ড. হুমায়ূন কবীর। তিনি নিয়মিত পড়েন। সেই সঙ্গে শিশু শিক্ষার্থীদেরও পড়ান। শুধু তাই নয়, কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আড্ডাও দেন। তার কাছে পড়তে এবং আড্ডা দিতে পেরে মুগ্ধ শিশু শিক্ষার্থীরা। সপ্তাহের দুটি দিন শিক্ষার্থীদের পিছনে ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে তিনি যশোরের বেশ কয়েকটি স্কুলে পাঠদান করিয়েছেন। তার মতে, এ দেশের কোনো মানুষ অশিক্ষিত থাকবে না। সব মানুষই অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হবে। শিক্ষিত মানুষই সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে পারবে।

মানুষ যখন শিক্ষিত হবে তখন দেশ উন্নতি লাভ করবে। কারো কাছে হাত পাততে হবে না। আজ থেকে প্রায় ৩৩ বছর আগে বিদ্যালয় ছাড়লেও, বিদ্যালয় তাকে ছাড়েনি। সেই ছাড়া-নাছাড়ার টান এখনো রয়েছে তার মধ্যে। এ কারণেই এখনো নিয়মিত পাঠশালায় যান। সেখানে কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের পড়ান। শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানোর জন্য তাকে নিয়মিত পড়তে হয়।

chardike-ad

ড. হুমায়ূন কবীর ১৯৬৫ সালে খুলনা বকশীপাড়া এলাকায়  জন্মগ্রহণ করেন। তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় খুলনার প্রিন্স আগা খান কিন্ডার গার্টেন স্কুলে। এই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর ১৯৮১ সালে খুলনা সেন্ট যোসেফ স্কুল থেকে এসএসসি সম্পন্ন করার পর ১৯৮৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনপ্রশাসন বিষয়ে বিএসএস (অনার্স) ও ১৯৮৮ সালে এমএসএস (মাস্টার্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। একাদশ বিসিএস ক্যাডারে ১৯৯৩ সালে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। সরকারি প্রশাসনের ক্যাডার হিসেবে যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এর আগেও যশোর জেলায় বাঘারপাড়া উপজেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। এরপর ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনপ্রশাসন বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি নেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করেন। শুধু তাই নয়, মোনাশ কলেজ, মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয় ও মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে হংকং ক্যাম্পাসে শিক্ষকতা করেন। ব্যক্তি জীবনে তিন সন্তানের জনক এই জেলা প্রশাসক। তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। বড় মেয়ে নবম শ্রেণি ও ছোট মেয়ে ক্লাস ওয়ানে পড়ছে। জেলা প্রশাসক ড. হুমায়ূন কবীর চলতি বছরের ১ জুলাই যশোর জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ  (পিপিপি) প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

যশোরে যোগদান করার পরই জেলার শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেন। ছুটে যান বিভিন্ন স্কুলে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাঠদান সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে থাকেন। এরপর তিনি সহজে পাঠদান ও মুখস্থ করার চেয়ে বুঝে পড়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দেন।

বিদ্যালয়ে পাঠদান সম্পর্কে জেলা প্রশাসক ড. হুমায়ূন কবীর বলেন, বিদ্যালয়ে গেলে এখনো নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে। এখনো নিজের পাঠশালাকে দেখতে পায়। শিশুদের মধ্যে নিজের শৈশবকে খুঁজে ফিরি।
তিনি আরো বলেন, শিশুদের ৫ বছর পর্যন্ত মানসিক বিকাশ হয়। এরপর তাদের আর তাদের মানসিক বিকাশ ঘটে না। শিশুদের বিকাশ ঘটাতে হলে অভিভাবকদের শিশুদের প্রতি সময় দিতে হবে। আমরা চাকরি কিংবা ব্যবসা করি শিশুদের জন্য। তাদের ভালো থাকা, ভালো খাওয়ার জন্য। ওদের জন্য সব কিছু করা। কিন্তু এত সব করলেও তাদের সময় দিই না। শিশুদের প্রথমত সময় দিতে হবে। বাবা-মা সন্তানের প্রথম বন্ধু। সন্তানকে বন্ধু হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তারা যদি ভালো বন্ধু পায় তাহলে ভালোভাবে গড়ে উঠবে। সন্তানকে বন্ধুর মতো গড়ে তুলতে পারলে সে সন্তান কখনোই বিপথগামী হবে না।
আমাদের সময় পাঠশালা এত সুন্দর না থাকলেও বিদ্যালয়ে যাওয়ার আনন্দই আলাদা ছিল। অনেক দূরের প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পাঠশালায় গিয়ে পড়তে হতো। হেঁটে চলা সেই বিদ্যালয়ের কথা আজও মনে পড়ে।

শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনমুক্ত শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করে ভীতিমুক্ত পরিবেশে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে হবে। যা জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশু সুরক্ষা ও শিশুর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ড. হুমায়ূন কবীর মাসে অন্তত দুইবার কালেক্টরেট স্কুলে ২ ঘণ্টা করে ক্লাস নেবেন বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সুলতান আহমেদ। ডিসি সাহেব তার ছুটির দিন শনিবারই দুইবার ক্লাস নেবেন কালেক্টরেট স্কুলে। জেলা প্রশাসকের লব্ধ জ্ঞান শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলেই প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।  শুধু জেলা প্রশাসকই নয়, তার স্ত্রীও শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেন। আর এতে করে শিশুদের মনের বিকাশ ঘটে।

কালেক্টরেট স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহাথির জানান, ডিসি স্যার আমাদের সমাজ পড়িয়েছিলেন। সমাজের আমাদের দায়িত্ব, পরিবারের দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আমাদের জানান। শুধু কালেক্টরেট স্কুলই নয়, তিনি গত সাড়ে তিন মাসে যশোর জিলা স্কুল, সরকারি বালিকা বিদ্যালয় (মোমিন গালর্স) স্কুলসহ অন্তত ২০টি স্কুলে পাঠদান করিয়েছেন।

সরকারি বালিকা বিদ্যালয় (মোমিন গার্লস) নবম শ্রেণির বাাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া জাহান জানান, ‘কিভাবে পড়াশোনা করতে হবে সে সম্পর্কে স্যার আমাদের ধারণা দিয়েছিলেন। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসে কি কি শেখানো হয়, কিভাবে শিখতে হয় সম্পর্কেও জানিয়েছিলেন। আমাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানিয়েছেন।’ একই ক্লাসের শিক্ষার্থী ফারহানা সুলতানা জানান, ‘স্যার ইংরেজিতে নিজের সম্পর্কে একটা প্যারাগ্রাফ লিখতে দিয়েছিল। এরপর নিজের পড়াশোনা সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের কাছ থেকে জেনেছিল। এরপর তিনি লেখাপড়ার বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের জানিয়েছিলেন।’
তার স্ত্রী রুনা লাইলাও একজন গুণী শিক্ষক। তিনি একাডেমিতে শিক্ষকতা করতেন। এছাড়া বিদেশ থেকে শিশুদের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। মিসেস রুনা লাইলাও কালেক্টরেট স্কুলে শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন। তিনি অষ্টম শ্রেণিতে বিজ্ঞানের ক্লাস নিয়েছেন। তার কাছে আনন্দময় পাঠদানে খুশি শিক্ষার্থীরা।

অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারহানা ইয়াসমিন বৃষ্টি বলেন, ‘ম্যাডাম খুব ভালো পড়ান। বুঝিয়ে পড়ান। তিনি প্রথম দিন বিজ্ঞানের খাদ্য ও পুষ্টি অধ্যায় পড়িয়েছিলেন। এছাড়া বিদেশি সাংস্কৃতিক কেমন, সে সম্পর্কেও ধারণা দিয়েছিলেন।’ ‘তিনি বলেছিলেন, জীবনে যে লাইনে উন্নতি করতে পারবা সে লাইনে যাওয়া উচিত বলে আমাদের জানিয়েছিলেন।’ এই ক্লাসের শিক্ষার্থী সালামুন হাসান জানান, স্যার আমাদের ক্লাস নিচ্ছিলেন, সে সময় ম্যাডাম ক্লাসে আসেন। তিনি আমাদের এক ঘণ্টা ১০ মিনিট ধরে বিজ্ঞান ক্লাস নিয়েছিলেন। তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন।

জেলা প্রশাসক বলেন, আমাদের দেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আনন্দময় ও নিরাপদ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতে করে শিক্ষার ঝরে পড়ার হার কমবে। তিনি আরও বলেন, শিশুদের সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঙ্কট দূর করার পাশাপাশি ইভটিজিং বন্ধ করতে হবে। পাঠশালায় বিনোদনের পাশাপাশি শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। অভিভাবকদের অর্থনৈতিক সঙ্কট সমস্যা সমাধান করে শিশুশ্রম বন্ধ করে শিশুদের পাঠশালামুখি করার পাশাপাশি উপস্থিতির হার বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে বল্যবিবাহও বন্ধ করতে হবে। আর এসব কাজে শিক্ষকদের সর্বপ্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকরা যাতে বিদ্যালয়ে যান তারও ব্যবস্থা করতে হবে। এখানকার শিক্ষকদের বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনতে পারলে তারাও ভালো করবে। তার পরিকল্পনা রয়েছে যশোরের কয়েকজন শিক্ষককে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। আর এই কাজটা এমনভাবে করবেন যাতে ওই শিক্ষকদের কাছ থেকে অন্য শিক্ষকরাও কিছু শিখতে পারে। ‘জীবনটা আমরা যত বড় মনে করি, জীবনটা তত বড় নয়।’ জীবনে সাফল্য পেতে হলে স্বপ্ন দেখতে হবে। সেই স্বপ্ন পূরণে প্রত্যাশা থাকতে হবে। তাহলেই জীবনের স্বর্ণ শিখরে ওঠা যাবে।’ ‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন কিছু জানার ও করার আগ্রহটা ছড়িয়ে দিতে হবে।’ বিদ্যালয়ে পানি ও স্যানিটেশন সমস্যা, খেলার মাঠ, ল্যাব, লাইব্রেরি, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, কমনরুম, নিরাপদ সড়ক ও ছাত্রাবাসের অভাব দূর করতে হবে। এসব সমস্যা নিরসন করা গেলে ভালো শিক্ষার্থী গড়ে তোলা যাবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে শিশুদের মনের মতো করে গড়ে তুললে অভাবনীয় ফল পাওয়া যায়। তার দেখানো পথে দেশের সব বিদ্যালয় এগিয়ে যাবে। শিশুরা সুন্দর হবে। এজন্য তিনি নিরলসভাবে শিশু শিক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যালয়ে গিয়ে শিশুদের নিজের মতো করে গড়ে তুলতে চাচ্ছেন।

ড. হুমায়ূন কবীর এক সময় ভালো ফুটবল খেলতেন। জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় দলের তারকা ফুটবলার আসলামের সঙ্গে তিনি ফুটবল খেলেছেন। ফুটবল খেলায় তার টার্গেট ছিল ১০ নম্বর দিতে হবে। খুলনা অঞ্চলের অনেক টিমে ফুটবল খেলেছেন। লেখাপড়া-খেলাধুলার পাশাপাশি এক সময় সাহিত্যও চর্চা করেছেন। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় তার সাহিত্য চর্চা ছিল বেশ বলে জানান। নানা কজের পরও তিনি প্রতিদিন রাতে দু’ঘণ্টা শিক্ষার বিষয়ে রিসার্চ করেন বলে জানালেন।

এই উদ্যোগ সম্পর্কে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)  মুহাম্মদ সোহেল হাসান বলেন, শিক্ষকের অপরিসীম যত্ন আর মেধাবী হাতের ছোঁয়ায় বদলে যেতে পারে শিশুদের জীবন। পড়তে পড়তে খেলা আর খেলতে খেলতে পড়া বিষয়টি চর্চা করতে পারলেই শিশুরা লেখাপড়ায় আরও বেশি মনোযোগী হতে পারবে। আর এভাবেই একটি বিদ্যালয় দেশ-বিদেশে মডেল হতে পারবে। একজন শিক্ষকের সৃজনী মনের জাদুবলে সত্যিই আঁধার ঘরে মানিক জ্বলবে। বিদ্যালয়ে থাকবে না কোন বেত, শিক্ষকদের চোখ রাঙানি তাহলেই শিশুর মেধা বিকাশ ঘটবে। শিক্ষকের হাতে তালি, শিশুর মুখে হাসি থাকলেই শিক্ষার মধ্যে জীবন খুঁজে পাবে শিশুরা। আলোকিত বাংলাদেশ।