শারমিন আক্তার জুঁই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এ বছর মানবিক বিভাগে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। একই কলেজ থেকে ২০১২ সালে এসএসসি পরীক্ষায়ও একই ফল করে সে। কিন্তু এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাসই করতে পারেনি সে। ১২০ নম্বরের মধ্যে জুঁই পেয়েছে ১৬ দশমিক ২০ নম্বর। বাংলায় পেয়েছে ৩। আর ইংরেজিতে ৮.৭০। সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলীতে পেয়েছে ৪.৫০। আর সাধারণ জ্ঞানের আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীতে পেয়েছে শূন্য।
ঢাকা বোর্ড থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় উভয়টিতেই জিপিএ ফাইভ পেয়েছিল জাহানারা বেগমও। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেনি সে। গ ইউনিটের ১২০ নম্বরের মধ্যে সে পেয়েছে ২৭.৩০ নম্বর।
বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অথৈ নীলিমা রাজশাহী বোর্ড থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অতিরিক্ত বিষয় ছাড়াই জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান অনুষদের ক ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় সেও পাস করেনি।
নীলিমা বক্তব্য, ‘সব পরীক্ষায় এত সুন্দর ফলাফল করলাম। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বরই পেলাম না। খুবই আপসোস হচ্ছে।’
পরীক্ষার ফলাফলে সনাতন পদ্ধতির বদলে জিপিএ চালুর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে এসএসসি এবং এইচএসসিসে বাড়ছে সর্বোচ্চ গ্রেড (জিপিএ ফাইভ) পাওয়ার সংখ্যা। মুখস্থ বিদ্যার বদলে শিক্ষার্থীদের চিন্তার ক্ষমতা বাড়াতে ‘সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি’ও চালু করেছে সরকার। কিন্তু শিক্ষায় সংখ্যার বিস্ফোরণ হলেও মানের দিক থেকে আসলে দেশ এগিয়েছে না কি পিছিয়েছে সে বিতর্ক চলছে জিপিএ পদ্ধতি চালুর পর থেকেই। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফলাফলের পর এই বিতর্ক আরও বড় হয়ে উঠেছে। এমন ফলাফলে হতবাক হয়েছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় যে পুরোটাই একটা মেকি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, এই ফলাফলই তার প্রমাণ।
কেবল এবার নয়, গত চার বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে এমন প্রবণতা চলছে। বরং ধারাবাহিকভাবে খারাপ করছে শিক্ষার্থীরা। তবে এবার অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সব বিভাগ এবার ছাত্রও পাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন সদরুল আমিন বলেন, ‘এইচএসসি ও এসএসসি পরীক্ষা যারা ১০০ নম্বরের মধ্যে ৮০ পেল তারা কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ১২০ নম্বরের মধ্যে ৪৮ পেল না? এটা নিয়ে এখনই ভাবার সময়।
অভিভাবকরাও বুঝতে পারছেন না তাদের সন্তানরা ১২ বছর ভালো ফলাফলের পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় এসে কেন এমন করছে।
তাবাস্সুম ফারিয়া নামে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আক্ষেপ করে বলেন, ‘মেয়ের পেছনে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য কোচিং করিয়েছি। বাসায় তিনজন শিক্ষক রেখেছি। তারা বাসায় এসে পড়িয়েছেন। তারপরেও কেন আমার মেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বরটুকুও পেল না তা বোধগম্য নয়।’
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বাজে ফলাফলের পর শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা উঠেছে দেশজুড়ে। কোথায় এবং কেন দুর্বলতা রয়ে যাচ্ছে ছাত্রদের, সে বিষয়ে মানুষ বলছে নানা কথা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার মেয়েও এবার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় খারাপ ফল করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাটাই উল্টো। আগে একজন শিক্ষার্থী প্রথম বিভাগে পাস করলেই পুরো গ্রামে বা এলাকায় হইচই শুরু হয়ে যেত। অনেকেই তাকে দেখতে আসত। কিন্তু এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, হাজার হাজার জিপিএ ফাইভ। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই নয়।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করেছে। এছাড়া বাসায় চারজন গৃহশিক্ষক রাখা হয়েছে। আমি নিজেও তাকে গাইড করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। সে পাসই করল না। এর চেয়ে হতাশা আর কি থাকতে পারে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সদরুল আমিন বলেন, ‘ যারা সর্বোচ্চ ফলাফল করেও ভর্তি পরীক্ষায় পাস করল না তাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া কিছু বলার নেই।’ তিনি বলেন, ‘গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ দিয়ে শিক্ষার মান যাচাই করা যায় না। তারা ভালো শিক্ষক পাচ্ছে না। আবার তাদের যোগ্যতার চেয়ে নম্বর বেশি দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে তারা পাবলিক পরীক্ষায় ভালো করলেও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পাস করছে না। এছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তো আছেই।’
একই সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘গ্রেডিং সিস্টেম চালু হওয়ায় শিক্ষকরা পরীক্ষায় বেশি নম্বর দেয়। এছাড়া এমসিকিউতে নম্বর বেশি পাওয়া যায়। আগে (ডিভিশন সিস্টেম) বর্ণনামূলক প্রশ্নে নম্বর কম দেওয়া হতো। ৭০ শতাংশ নম্বর পেত দু- একজন। আর এখন গ্রেডিং সিস্টেমে অনেকে সর্বোচ্চ নম্বর পাচ্ছে। গ্রেডিং সিস্টেমে ১০০ থেকে নম্বর দেওয়া শুরু হয়। অর্থাৎ ১০০ থেকে কত কম পেলÑ এ রকম হিসাব করা হয়।
সব ইউনিটেই পাসের হার ন্যূনতম
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাবির ক, খ ও গ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় মোট ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯১৫ জন পরীক্ষার্থী। যাদের মধ্যে পাস করেছে ৩০ হাজার ৬২০ জন। শতকরা হিসেবে যা ১৭.১৮ শতাংশ। ক ইউনিটে পাস করেছে ২১.৫০, খ ইউনিটে ৯.৫৫ শতাংশ এবং গ ইউনিটে ২০.৬১ শতাংশ।
২০১৪ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ই জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। এর সঙ্গে যুক্ত হবে গত বছরের জিপিএ-৫ পাওয়া ৫৮ হাজারের প্রায় চারভাগের তিনভাগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি অফিস সূত্রে জানা যায়, ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রায় দুই লাখ ভর্তিচ্ছুর মধ্যে একটি বড় অংশই মাধ্যমিক অথবা উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ফাইভ আছে। অনেকের আবার দুটিতেই সর্বোচ্চ গ্রেড আছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর ১২০-এর মধ্যে ৪৮। তবে ‘খ’ ইউনিটে চারটি অংশে (বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞানের দুটি অংশে আলাদাভাবে পাস করতে হয়। ৩০ এর মধ্যে ৮ পেতে হয়। ‘গ’ ইউনিটে কেবল ইংরেজিতে ৩০ এর মধ্যে ১২ পেতে হয়। মেধা তালিকায় আসার এ শর্ত পূরণ করতে পারেনি শতকরা ৮২.৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী।
বিজ্ঞান অনুষদের অধীন ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছে ২১.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। মোট ১ হাজার ৬৪০ আসনের বিপরীতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় ৭৮ হাজার ২৯৩ জন ভর্তিচ্ছু। এদের মধ্যে ন্যূনতম পাস নম্বর পেয়েছে ১৬ হাজার ৮৪০ জন। বাকি ৬১ হাজার ১৫৫ জনই ফেল করেছে।
এ বছর সবচেয়ে শোচনীয় ফল হয়েছে মানবিক অনুষদের অধীন খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায়। এ অনুষদে পাস করেছে মাত্র ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। খ ইউনিটের ২ হাজার ২২১টি আসনের বিপরীতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় মোট ৪০ হাজার ৫৬৫ ভর্তিচ্ছু। এদের মধ্যে পাস করে মাত্র ৩ হাজার ৮৭৪ জন।
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অধীন গ ইউনিটের ১ হাজার ১৭০ আসনের পরীক্ষায় অংশ নেয় ৪৮ হাজার ৫৭ জন। পাস করেছে ৯ হাজার ৬ জন। পাসের হার ২০.৬১ শতাংশ।
ছাত্র পাবে না সব বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে ভর্তির জন্য এ বছর নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে। যে সব শিক্ষার্থী ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হতে ইচ্ছুক তাদের ইলেকটিভ ইংরেজির উত্তর দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ইলেকটিভ ইংরেজির উত্তর দিতে পারেনি প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। আবার যারা ইলেকটিভ ইংরেজির উত্তর দিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই পাস করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর মাত্র দুইজন শিক্ষার্থী ইংরেজিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।
ইংরেজি বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আসন আছে ১২৫টি। মাত্র দুইজন ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করায় কী হবে তা বুঝে উঠতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
কলা অনুষদের ডিন সদরুল আমিন বলেন, ‘বিষয়টি আমরা উপাচার্যকে জানিয়েছি। এ নিয়ে বিকল্প কি করা যায় তা ভাবছি।’
‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ৫টি অংশ ছিল। এগুলো হলোÑ সাধারণ ইংরেজি, বাংলা, ইলেকটিভ ইংলিশ, সাধারণ জ্ঞান ‘এ’ ও সাধারণ জ্ঞান ‘বি’। শিক্ষার্থীদের পাঁচটির মধ্যে চারটি অংশ নিজেদের যোগ্যতাসাপেক্ষে নির্বাচন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রত্যেক বিষয়ে মোট ২৫টি প্রশ্নে ৩০ নম্বর। এক ঘণ্টায় মোট ১২০ নম্বরের পরীক্ষা হয়।
ভর্তি নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়, ইংরেজি বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষায় পাসসহ সাধারণ ইংরেজিতে ২০ নম্বর পেতে হবে। তবে ভর্তি পরীক্ষার তিনদিন আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর পরীক্ষায় উত্তরপত্রের বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ইংরেজি বিভাগে ভর্তিচ্ছুকদের জন্য ইলেকটিভ ইংলিশ অংশের উত্তর দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। ইংরেজি বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে সাধারণ ইংরেজিতে ২০ নম্বর পাওয়ার পাশাপাশি ইলেকটিভ ইংলিশে ১৫ নম্বর পেতে হবে বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘সব নিয়মকানুন ভর্তির নির্দেশিকায় দেওয়া ছিল। এ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ নেই। তবে ইংরেজি বিষয়ে যে শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না সেটি শুনেছি। এ বিষয়ে আলোচনা করে করণীয় ঠিক করা হবে।’
সমস্যা কেবল এক বিষয়ে নয়, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হতে হলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে বাংলা এবং ইংরেজিতে ২০০ নম্বর থাকতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় আলাদাভাবে বাংলায় ১৪ এবং ইংরেজিতে ১৬ নম্বর পেতে হবে। অর্থনীতি বিভাগ পেতে হলে উচ্চমাধ্যমিকে অর্থনীতি নিয়ে ২০০ নম্বর থাকতে হবে। আর ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজিতে ১৬ নম্বর পেতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন বিভাগেও আছে নানা শর্ত। এসব শর্ত পূরণ করে এবার বিভাগগুলোতে পর্যাপ্ত ছাত্র ভর্তি করা অসম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা।
গাইড বইয়ের রাজত্ব ঠেকাবে কে
গাজীপুরের শ্রীপুরের মুলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে শিমলা। তার শিক্ষক বলে দেওয়ার পর একের ভেতরে সব নামে একটি বই কিনেছেন যেটি তার সব বইয়ের তুলনায় বেশি মোটা।
একই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সমাপনী পরীক্ষার ইন্টারনেট গাইড কেনার নির্দেশ দিয়েছেন।
বই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাইড বই বিক্রি হলে শিক্ষকরা কমিশন পায়। এ কারণে তারা শিক্ষার্থীদের বইগুলো কিনতে বাধ্য করেন। অথচ শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যার বদলে যেন যেকোনো বিষয়ে ভালোভাবে বুঝেশুনে পড়ে সে জন্য শিক্ষাবিদরা নির্দিষ্ট ধাঁচে প্রশ্নের বদলে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন করার সুপারিশের পর সরকার পাল্টে দেয় পুরো প্রশ্নপদ্ধতি। সেই সঙ্গে গাইড বই নিষিদ্ধ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এতসব করা হয় তা ব্যর্থ হয় পুরোপুরি। সহায়ক বই নামে এখনও দেদার বিক্রি হচ্ছে গাইড বই। সরকার কখনো কখনো এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও কার্যকর কিছুই করে না।
এসব বইয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন কেমন হতে পারে এবং সেগুলোর সম্ভাব্য উত্তর দেওয়া থাকে। আর সেগুলো মুখস্থ করে ছাত্ররা। ফলে মুখস্থ বিদ্যার বদলে চিন্তার বিকাশের উদ্যোগ মাঠে মারা গেছে বলেও মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মধ্যদিয়েই প্রমাণ হয়েছে শিক্ষার্থীদের বেহাল দশা। শুধু মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে যে বেশি দূর যাওয়া যায় না সেটিই প্রমাণ হলো।’
প্রাইভেট ও কোচিংনির্ভর পড়াশোনা
৬ বছরের ওয়ারিসা। রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরের একটি স্কুলে নার্সারিতে পড়ে। এতটুকু বয়সেই তার জন্য গৃহশিক্ষকদের ব্যবস্থা করেছেন তার বাবা। নার্সারিতেই কেন গৃহশিক্ষক দিতে হলো জানতে চাইলে তার বাবা বলেন, ‘আমার বাসার পাশেই থাকেন মেয়ের স্কুলের শিক্ষিকা। তিনি বললেন, কেবল স্কুলের পড়ায় বাচ্চাদের চলবে না, তার একটি মেয়ে আছে সে পড়াতে পারে।’ ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে ওয়ারিসার বাবা তার মেয়েকে পড়াতে দেন স্কুল শিক্ষিকার মেয়ের কাছে। কেবল ওয়ারিসা নয়, সেখানে একই স্কুলের আরও অন্তত ৫ বাচ্চা পড়ে যাদের সবাই নার্সারির ছাত্রছাত্রী।
স্কুলে এই বাচ্চাদের বেতন দিতে হয় মাসে ৮০০ টাকা করে আর ওই গৃহশিক্ষক নেন ১০০০ টাকা। এত গেল নার্সারির কথা। প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে এইচএসসির প্রতিটি শ্রেণিতেই এভাবে এখন পড়াশোনা শ্রেণিকক্ষের বদলে হয়ে গেছে কোচিং বা প্রাইভেটনির্ভর। প্রাইভেট আবার পড়তে হয় একই স্কুল বা কলেজের শিক্ষকদের কাছে। নইলে নম্বর কম দেন শিক্ষকরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিষিদ্ধ করলেও তা কার্যকর করতে কোনো উদ্যোগই নেয়নি গত এক বছরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ফরিদ উদ্দিন বলেন, এখন কোচিং সেন্টারগুলো টাকা হাতিয়ে নেয়। তারা প্রতারণা শিখায়। তাদের ফাঁদে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরাও পা দেয়।’
অধ্যাপক ফরিদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যদি কোচিং বাদ দিয়ে মূল বই পড়ে তাহলে অনেক ভালো করবে। আগামীতে আমরা চেষ্টা করব কোচিং-এর কালো থাবা থেকে যেন শিক্ষার্থীরা বেঁচে যায়, সেই জন্য আগেভাগেই পরীক্ষা নিয়ে নেব। আর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, শুধু কোচিং আর নোট-গাইড পড়লেই ভালো মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়া যায় না। পাস করা আর জানা আলাদা বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে ভালো ফলাফল করলে চলবে না, ভালো জানতে হবে।’
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাচ্চারা আড়াই থেকে ছয় ঘণ্টা স্কুলে পড়ার পর আবার প্রাইভেট বা কোচিংয়ে ব্যয় করে আরও দুই থেকে চার ঘণ্টা। এরপর ক্লান্ত হয়ে বাসায় গিয়ে আবার ঘরের কাজ করতে হয় দুই ঘণ্টা এভাবেই চলছে দিনের পর দিন। এভাবে কোনো শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ হওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন শিশু বিশেষজ্ঞরা। আর জীবনের শুরুতেই মুখস্থ বিদ্যার অভ্যাস গড়ে তোলায় বাকি সময়েও তার একটি প্রভাব পড়ে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। আবার অভিভাবকরা শিশুদের পাঠ্যবহির্ভূত বই পড়তে নিরুৎসাহিত করেন পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটার কথা ভেবে। এতেও তাদের জ্ঞানের বিকাশ আটকে যাচ্ছে। এসব কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা শৈশব থেকেই আমূল পাল্টানো ছাড়া বিকল্প নেই বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মনোবিদ শামীম ফেরদৌস করিম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মনোজগতকে প্রস্ফুটিত করতে হলে তাদের মুক্তমনে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু এখন সেই সুযোগ শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। তারা অ্যাকাডেমিক বইয়ের চাপে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ছে। ফলে বাইরের বই বা বাইরের জ্ঞান সম্পর্কে তাদের ধারণা কম। এসব থেকে মুক্তি দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠতে দিতে হবে।’-এই সময়ের সৌজন্যে