গত ৯ আগস্ট রাজধানীর কাছে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে দুই তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় আসামি ছিল ছয়জন। এর মধ্যে একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। আসামিকে শনাক্ত করে এলাকার লোকজন আটকের পর থানায় নিয়ে আসে। বাকি আসামিরা পুলিশের খাতায় ‘পলাতক’।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গত ৭ সেপ্টেম্বর এক প্রবীণ নারী (৬৫) দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। তিনি ত্রাণের আশায় কয়েক নারীর সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন। ঘটনার সময় উদ্যানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ওই মামলায় আসামি অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজন। মামলাটি শাহবাগ থানা থেকে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগে (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার নামে বেশি পরিচিত) স্থানান্তর করা হয়েছে। ওই মামলায় এখন পর্যন্ত কোনো আসামি শনাক্ত হয়নি। ফলে গ্রেপ্তার হয়নি কেউ।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর ৯ (৩) ধারায় দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে ওই দুটি ঘটনায় থানায় মামলা হয়।
দেশের বিভিন্ন থানার মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একক ধর্ষণের ঘটনা ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতনের ঘটনায় আসামি থাকেন একাধিক ব্যক্তি। যৌতুকের মতো পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনায় স্বামীর সঙ্গে পরিবারের অনেক সদস্যকেও আসামি করা হয়। তবে মামলার পর আসামিদের বড় একটি অংশ পুলিশের নাগালের বাইরে থেকে যায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সারা দেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০–এর যৌতুক, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ ও অপহরণ ধারায় মোট ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু নারী নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৬টি। বাকিগুলো শিশু নির্যাতনের অভিযোগে। নারী নির্যাতনের মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে ২৪ হাজার ৩৩৯ জনকে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৮৩৫ জন। অর্থাৎ ওই ৯ মাসে প্রায় ৬৮ শতাংশ বা দুই–তৃতীয়াংশের বেশি আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।
তবে পরিস্থিতির উন্নতির আশা নিয়ে এ বছরও আজ ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন করা হবে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘নারী-কন্যার সুরক্ষা করি, সহিংসতামুক্ত বিশ্ব গড়ি’।
আগস্ট–সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার সবচেয়ে কম
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নির্বিচারে দমন করার কাজে পুলিশকে বেশি ব্যস্ত রাখা হয়। ওই সময় থানাগুলোতে গুরুতর ঘটনা ছাড়া নারীরা অভিযোগ জানাতে গেলে ফেরত পাঠানো হয়। বিশেষ করে পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনায় নারীদের পরে এসে মামলা করতে পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে জুলাই মাসে মামলা ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা বছরের অন্যান্য মাসের মতোই ছিল। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনরোষ ও হামলার মুখে থানার কার্যক্রম বন্ধ থাকে দীর্ঘদিন। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। তবে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আগস্ট মাসে নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা নেওয়া ও আসামি গ্রেপ্তার কমতে শুরু করে। সেপ্টেম্বরে নির্যাতনের ঘটনায় মামলার চিত্র প্রায় আগের পর্যায়ে চলে আসে। তবে ওই মাসেও আসামি গ্রেপ্তার কমই ছিল।
মামলার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মামলার তুলনায় আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে আসামি গ্রেপ্তার সবচেয়ে কম। অনেক সময় যে মাসে মামলা হয়েছে, তার পরের মাসে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। ৯ আগস্ট দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে দুই তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ২৩ দিন পর ২ সেপ্টেম্বর মামলা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, এ বছর জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে কম মামলা হয়, ৮৫০টি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কম মামলা হয় আগস্ট মাসে, ৮৮৯টি। ওই মাসে মোট আসামি করা হয় ২ হাজার ২৩৮ জনকে। গ্রেপ্তার হয় ৫৩০ জন। সেপ্টেম্বর মাসে মামলা হয় ১ হাজার ২৮৮টি। যা জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও জুলাই মাসের তুলনায় বেশি। সেপ্টেম্বর মাসে আসামি করা হয় ২ হাজার ৯৮৬ জনকে, গ্রেপ্তার হয় ৬১৭ জন।
পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর গণমাধ্যমকে বলেন, অনেক সময় আসামিরা আত্মগোপনে চলে যায়। তবে আসামি ধরার জন্য পুলিশ সর্বোচ্চ তৎপর থাকে। পুলিশের সক্ষমতায় কোনো ঘাটতি নেই।
৯ মাসে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৩৯৩টি। এর মধ্যে ২২৩টি দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর ১২ জনকে হত্যা, ধর্ষণচেষ্টা ১ হাজার ৪২৬টি। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ৩ হাজার ২০৮টি, এর মধ্যে ১৩৬ নারী হত্যার শিকার। অপহরণের ঘটনায় ২ হাজার ৬১৭টি এবং দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপের ঘটনায় ৪২টি মামলা হয়েছে।
নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সহায়তায় স্থাপিত ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, আসামি গ্রেপ্তার না হলে মামলার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়। বিচার না হলে ভুক্তভোগী যেমন ভোগান্তিতে পড়ে, তেমনি সমাজে অপরাধও বাড়তে থাকে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে হবে। ধর্ষণ, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ, পাচার, পর্নোগ্রাফির মতো সংবেদনশীল মামলার জন্য পুলিশের পৃথক তদন্তকারী সেল গঠন করা জরুরি।