Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
পশ্চিমা দেশগুলোর ট্রাভেল অ্যালার্ট প্রত্যাহারে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান পোশাক শিল্প মালিকদের
ছবি: সংগৃহিত

 

 

chardike-ad

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো যেন বাংলাদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিজ নাগরিকদের প্রতি জারি করা ট্রাভেল অ্যালার্ট বাতিল করে, সেজন্য সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে; একইসঙ্গে সংখ্যালঘু নির্যাতন করা হচ্ছে বলে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তা মোকাবিলা করতেও সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার বলে মনে করছেন পোশাক শিল্প মালিকরা।

এতে ব্যর্থ হলে,বাংলাদেশের পোশাক শিল্প প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছে ব্যবসা হারাবে বলেও সতর্ক করেছেন তাঁরা।

রোববার দেশের একটি বেসরকারি গণমাধ্যম আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেছেন পোশাকখাতের শীর্ষ উদ্যোক্তারা। এতে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বরেণ্য একজন ব্যক্তিত্ব, পশ্চিমা দেশগুলো যেন ট্রাভেল অ্যালার্ট তুলে নেয়, সেজন্য তিনি এটাকে কাজে লাগাতে পারেন।

‘এমনকী তাঁর একটি চিঠি বা টুইটও বড় প্রভাব রাখতে পারে,’ উল্লেখ করে রাকিব বলেন, ড. ইউনূসের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি কাজে লাগানো গেলে বিদেশি বায়াররাও আশ্বস্ত হবে।

বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান, ট্রাভেল অ্যালার্টের কারণে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘নিজ নিজ দেশের সরকারের ট্রাভেল অ্যালার্টের কারণে তাঁরা বাংলাদেশে আসতে স্বস্তিবোধ করছে না। মনে আশঙ্কা কাজ করছে। যদিও আমরা তাঁদেরকে বোঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছি, কিন্তু তাতে করে দেরী হচ্ছে, ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের দেশের বাইরে গিয়ে (বায়ারদের সঙ্গে) দেখা করতে হচ্ছে।”

কিন্তু, এভাবে বাইরে মিটিং করার ফলে বায়ারদের সাথে দর কষাকষির সুযোগ থাকছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিটোপি গ্রুপের প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম আজাদ জানান, বাংলাদেশে আসার টিকেট বুক করার পরেও শেষপর্যন্ত আর আসেননি স্পেনের একজন ডিজাইনার। কারণ হিসেবে তাঁর দেশের জারি করা ট্রাভেল অ্যাডভাইজরির কথা উল্লেখ করেন।

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান জানান, বাংলাদেশের ওষুধ পণ্যের সনদ দিতে আসার কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ)-র একটি প্রতিনিধি দলের, কিন্তু তারাও সফরটি বাতিল করেছে।

হাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই ট্রাভেল অ্যালার্টগুলো প্রত্যাহার না করা হলে সবখাতেই তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’ তবে এর সমাধানে সরকার কাজ করছে বলেও জানান তিনি।

চলমান অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য আরেকটি বড় বাধা বলে উল্লেখ করেন গোলটেবিল আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা।

তাঁরা বলেন, ছাত্রদের নেতৃত্বে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর— থানাগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগেছে। এছাড়া, কয়েক মাস ধরে আশুলিয়া ও গাজীপুরের মতো শিল্পাঞ্চলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর সড়ক অবরোধের ফলে যা আরও বাজে রূপ নিয়েছে।

শ্রমিকনেতা এবং সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পদত্যাগের দাবিতে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ এবং বিজিএমইএ’র আগের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার মতো ঘটনায়— বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা আরও হ্রাস পেয়েছে।

গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালনা করেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের উপ-সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান। যেখানে যোগ দেন শিল্প নেতা, অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা। দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তিকে রক্ষার স্বার্থে – দ্রুত স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রতি গুরুত্ব দেন তাঁরা সকলে।

বায়ারদের আস্থা ফেরাতে যা দরকার

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ১১৫ দিন পার হয়েছে, কিন্তু এখনও বিদেশি ক্রেতারা তাঁদের হারানো আস্থা ফিরে পাচ্ছেন না। মূলত বিভিন্ন কারখানা ও শিল্প এলাকায় অস্থিরতার কারণেই এমনটা হয়েছে।

‘বর্তমানে আমরা ফায়ারফাইটিং এর মতো করে পরিস্থিতি সামলাচ্ছি, কিন্তু বায়ারদের আস্থা ফেরাতে হলে– এর একটা কৌশলগত সমাধান দরকার,’ যোগ করেন তিনি।

বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, বিজিএমইএ’র পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাও কাজ করে থাকতে পারে, যেকারণে বায়ারদের আস্থার আরও ক্ষয় হয়েছে।

আশুলিয়ার অন্যতম বৃহৎ একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ টেনে হাতেম বলেন, বর্তমানে এই কোম্পানির কারখানায় অর্ডার দিতেও দ্বিধা করছেন বায়াররা। ‘এতে আমাদের কর্মীদের চাকরির ওপর, জাতীয় অর্থনীতির ওপর এবং মালিকপক্ষ– সবার ওপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’

সবখাতে ন্যূনতম মজুরি

দেশে প্রধানত ৪৪টি খাত রয়েছে, এরমধ্যে কতগুলো খাতে নিম্নতম (ন্যূনতম) মজুরি কাঠামো রয়েছে সেই প্রশ্ন রাখেন বিকেএমইএ’র সভাপতি। তিনি বলেন, ‘সব খাতের জন্য সরকার একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো করুক, এতে করে শ্রমিকদের দক্ষতার ভিত্তিতে তাঁদের মজুরি নির্ধারণ করতে পারবে কারখানাগুলো।’

বিটোপি গ্রুপের প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম আজাদ মনে করেন, পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরিকে অন্য সবখাতে মজুরি নির্ধারণের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হলে – ফলে এটিই জাতীয় ন্যূনতম মজুরি হয়ে উঠবে।

ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘এটার বাস্তবায়ন করা গেলে, শ্রমিকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মজুরির ক্ষেত্রে যে তারতম্য রয়েছে – সেটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতির মাধ্যমেই সমাধান করতে পারবে কারখানাগুলো। এতে বিভিন্ন গ্রেডের শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি বৈষম্য নিয়ে অসন্তোষ কমবে।’

সব খাতের জন্য ন্যূনতম একটি জাতীয় মজুরি কার্যকরের এই পরামর্শকে সমর্থন জানান শ্রমিকনেতা নাজমা আক্তারও।

এলডিসি গ্রাজুয়েশন পেছান

মাসরুর রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের কাছে এলডিসি গ্রাজুয়েশন পেছানোর সুযোগ রয়েছে, সেটা নিতে হবে; নাহলে বিশাল সব চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে। এতে বিদ্যমান বাণিজ্য সুবিধাগুলোও হারাবে বাংলাদেশ।

তিনি বলেন, গত আড়াই বছরে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে পারেনি বাংলাদেশ, ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোর সামনে বাংলাদেশ এখনও বেশ দুর্বল। জরুরি ভিত্তিতে আমাদের প্রতিযোগী সক্ষমতার উন্নয়ন দরকার, কারণ প্রযুক্তি ও দক্ষতা অ্যাডাপশনের (আয়ত্তকরণে) ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৭ থেকে ৮ বছর পিছিয়ে রয়েছে।

এইক্ষেত্রে ফিজির উদাহরণ দিয়ে মাসরুর রিয়াজ বলেন, অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে পাঁচ বছর পর দেশটি তার এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরিবর্তন করে।

জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো)-এর একটি জরিপের ফলাফল উল্লেখ করে তিনি। ওই জরিপে অংশ নেওয়া ৬১ শতাংশ জাপানি প্রতিষ্ঠান জানায়, এলডিসি-পরবর্তী সময়ে জিএসপি বা এধরনের কোনো শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা না থাকলে— তারা বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা বন্ধ করবে।

তিনি আরও বলেন যে, এলডিসি গ্রাজুয়েশন হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানির ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৯ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে, অথচ প্রতিযোগী ভিয়েতনামের বিনা-শুল্কে বাজার সুবিধা অব্যাহত থাকবে।

ব্যবসা থেকে রাজনীতিকে আলাদা করতে হবে

মাসরুর রিয়াজ বলেন, ব্যবসার সার্বিক পরিবেশে যেন বিরূপ প্রভাব না পড়ে – সেজন্য অবশ্যই ব্যবসা পরিচালনার সাথে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকতে হবে। ‘শুধুমাত্র রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে যেন কাউকে ভোগান্তি না পোহাতে হয়,’ তিনি মন্তব্য করেন।

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পদ নেওয়া উচিৎ নয়, এতে ক্ষমতার যেকোনো পালাবদলের সময় পুরো খাতটি সমস্যার মধ্যে পড়ে।

নাজমা আক্তার বলেন, নিজদের রাজনৈতিক অবস্থান কাজে লাগিয়ে কিছু গার্মেন্টস মালিক শত শত কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ‘তাঁরা রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ করেছেন, এখন দুর্নীতির অভিযোগ বা অন্যান্য অভিযোগের মামলার কারণে গা ঢাকা দিয়েছেন। এতে পুরো শিল্পটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, ফলে বায়াররাও বাংলাদেশে কার্যাদেশ দিতে ভয় পাচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বায়াররা যেসব ব্যবসায়ীর সাথে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন – তাঁদের অনেকেই এখন জেলে, নয়তো আত্মগোপন করেছেন। ফলে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ ও স্থিতিশীলতা নিয়ে বায়াররা সন্দিহান।’

সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড