Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

খেলাপি ঋণের দায়ে প্রথমবারের মতো এস আলম গ্রুপের বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে উঠছে

 

chardike-ad

এস আলম গ্রুপের কাছ থেকে এক হাজার ৮৫০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য জনতা ব্যাংক গ্রুপটির অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের জামানত সম্পত্তি নিলাম করার ঘোষণা দিয়েছে।

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের মেয়াদে এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের মধ্যে এ প্রথমবারের মতো একটি ব্যাংক গ্রুপটির একটি কোম্পানির বন্ধক রাখা সম্পদ নিলামে ওঠানোর পদক্ষেপ নিল।

জনতা ব্যাংক ১ নভেম্বর পত্রিকায় নিলাম সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আগামী ২০ নভেম্বরকে নিলামের তারিখ ঘোষণা করেছে।

ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তথ্য অনুযায়ী, এ ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা হয়েছে চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে এস আলম গ্রুপের ১৮৬০ শতাংশ জমি, যার বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ৩৫৮ কোটি টাকা। এ দাম পাওনা টাকার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ কম।

জনতা ব্যাংক জানিয়েছে, এ সম্পত্তি বিক্রি করে খেলাপি ঋণ পুরোপুরি আদায় করা সম্ভব নয়। বকেয়া বাকি টাকা আদায়ে আরও আইনি পদক্ষেপের প্রয়োজন হতে পারে। অর্থঋণ আদালত আইনের ১২(৩) ধারা অনুযায়ী ব্যাংক মামলা করার আগেই জামানতের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আদায় সম্ভব।

বাংলাদেশের কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)-এর ২০২১ সালের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিকা না মেনে ঋণসীমা অতিক্রম করে অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছে।

এস আলম গ্রুপের ওয়েবসাইট অনুসারে, ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন শিল্প কাঁচামাল, বাণিজ্যিক পণ্য এবং নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসায় জড়িত ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ সালে সাধারণ বীমা ভবনে অবস্থিত জনতা ব্যাংকের চট্টগ্রাম কর্পোরেট শাখা থেকে গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন প্রাথমিকভাবে ৬৫০ কোটি টাকা ঋণ নেয়।

এ ঋণ ২০২১ সাল পর্যন্ত সুদে আসলে মোট এক হাজার ৭০ কোটি ৬৫ লাখ টাকায় পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৬১৭.৪৭ কোটি টাকা পিএডি (পেমেন্ট এগেইনস্ট ডকুমেন্ট), ২২৩.১৮ কোটি টাকা এলটিআর (ট্রাস্ট রিসিপ্ট) ঋণ এবং ২২৯.৯৯ কোটি টাকা সিসি হাইপো ঋণ।

সুদাসল মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এক হাজার ৮৫০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য এস আলম গ্রুপের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি টিবিএসকে বলেন, ‘এ বিষয়ে কিছু জানা নেই।’ তিনি মুবিন নামক গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তার ফোন নম্বর দিয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন, তবে সে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এস আলম গ্রুপের সাধারণ ব্যবস্থাপক (জিএম) দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিষয়টি কার কাজের ক্ষেত্রের বাইরে।

পদ্ধতিগত লঙ্ঘন

সিএজি-এর ২০২১ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ঋণের পরিমাণ অনুমোদিত ঋণের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

নিরীক্ষাকালে আরও দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণ না করে এক ঋণের অর্থ দ্বারা অন্য ঋণের দায় সমন্বয়ও করেছে কোম্পানিটি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংকটি এটির ঋণের সীমা অতিক্রম করে অনুমোদিত সীমার বিপরীতে এক হাজার ৭০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছে মূলত অপর্যাপ্ত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের কারণে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে ১৬টি সম্পত্তিতে বিস্তৃত ১,৮৬০ দশমিকেরও বেশি জমি এ ঋণের জামানত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

২০২১ সালের হিসেবে বন্ধকি এ জমির সর্বোচ্চ বাজারমূল্য ৩৫৮ কোটি টাকা। তবে ২০১০ সালে ঋণ অনুমোদনের সময় ওইসব জমির বাজারমূল্য আরও কম ছিল।

তৎকালীন সিএজি মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঋণ প্রদানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত ঋণ ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা লঙ্ঘন করা হয়েছে।

নিরীক্ষা চলাকালে এ ঋণ সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে অর্থ বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব (পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর) আব্দুর রউফ তালুকদার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবীরের কাছে চিঠি পাঠায় সিএজি অফিস।

যা বলছে গ্লোবাল ট্রেডিং ও জনতা ব্যাংক

জনতা ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম মর্তুজা এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ফোন কল ও ক্ষুদেবার্তার জবাব দেননি।

তবে ব্যাংকটির চট্টগ্রাম কর্পোরেট শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) বাদল কান্তি দাস ব্যাংকের বন্ধক রাখা জমি নিলামের সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, ব্যাংক অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতে এবং আসন্ন নিলাম সম্পর্কে জানাতে জমিগুলোতে ব্যাংকের সাইনবোর্ড লাগিয়েছে।

তিনি জানান, নিলামের নির্ধারিত দিনে কোনো বিডার না পাওয়া গেলে জনতা ব্যাংক এ সম্পত্তি ব্যাংকের দখলে নিতে আদালতের দ্বারস্থ হবে।

তিনি আরও বলেন, বকেয়া ঋণের মোট টাকা ওঠাতে ব্যাংক গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন এবং এস আলম গ্রুপের অন্যান্য সম্পত্তি থেকে পাওনা আদায়ের জন্য অতিরিক্ত আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে।

সাত হাজার ৮৩২ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের পর এস আলম গ্রুপ জনতা ব্যাংকের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা। ব্যাংকের ২০২৩ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, এস আলম গ্রুপের শ্রেণিবদ্ধ ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ২১৫ কোটি টাকা।

এস আলম গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল লিমিটেড প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ব্যাংকটির ১০তম বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

এগুলো ব্যাংকের একক ঋণগ্রহণের সীমার উল্লেখযোগ্য লঙ্ঘন। আইন অনুযায়ী, কোনো একটি গোষ্ঠীকে ব্যাংকের মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ (জনতা ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৫৭৮ কোটি টাকা) ঋণ দেওয়া যায়।

তা সত্ত্বেও এস আলম গ্রুপ বিগত সরকারের আমলে জনতা ব্যাংকের মূলধনের ৪২০ শতাংশ পরিমাণ ঋণ পেয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অপরিশোধিত এসব ঋণের বেশিরভাগই আমদানির কথা বলে নেওয়া হয়েছিল।

হাসিনা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক—এ সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে ছিল এস আলম গ্রুপের কাছে।

এসব ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এস আলম গ্রুপ অন্তত দুই লাখ কোটি টাকা বের করে তার বেশিরভাগই পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সরকার পরিবর্তনের পর এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ৫৬টি সংস্থা এবং ব্যক্তির শেয়ার স্থগিত [ফ্রিজ] করার নির্দেশ দিয়েছে।

এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) এসব শেয়ার স্থগিত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো তালিকায় গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের নাম রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এচ মনসুর গত ২৮ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এস আলম গ্রুপের ব্যাংক কেলেঙ্কারি পদ্ধতিগতভাবে ‘বিশ্বের অন্যতম বড় ব্যাংক লুটের’ ঘটনা।

এস আলম গ্রুপের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে বলে জানিয়ে তিনি গ্রুপটির সম্পদ কিনতে কাউকে উৎসাহিত না হওয়ার আহ্বান জানান।

এস আলম গ্রুপের গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদ (এস আলম)। চট্টগ্রামভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটি পাওয়ার ও গ্যাস নিয়ে ট্রেডিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। এস আলম ও তার পরিবারের ওপর ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে তারা দেশের বাইরে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।