ষাটের দশকে চট্টগ্রামের মাদারবাড়িতে জন্ম নেওয়া শাখাওয়াত স্বপ্ন দেখতেন পাইলট হবেন। তবে বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে হবে ব্যারিস্টার। শাখাওয়াতের পাঁচ ভাই। বাবা চাইতেন ছেলেরা একেকজন একেক পেশায় যাক। তবে যে যাই করুক, সে জায়গায় সবচেয়ে ভালো করুক। শাখাওয়াত তাই করলেন। শুধু ভালোই করলেন না, নিজের ক্ষেত্রে হয়ে উঠলেন সেরাদের একজন।
১৯৭৯ সালে এসএসসি, ১৯৮১ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার প্রস্তুতি হিসেবে প্রি-এলএলবি করতে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহামার ইউনিভার্সিটি অব টালসায় যান। প্রথম দুই সেমিস্টারের পর মেজর বিষয় নেওয়ার নিয়ম। তখন কম্পিউটার নিয়ে পড়ালেখা করলে যুক্তরাষ্ট্রেই ভালো চাকরি পেতে পারেন এমন ধারণা থেকে বেছে নেন ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম’। স্নাতক শেষ বর্ষে ১৯৮৭ সালে প্রোগ্রামার হিসেবে ডাক আসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রাকৃতিক গ্যাস প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পরিবহন প্রতিষ্ঠান দি উইলিয়াম কোম্পানিজে। মজার ব্যাপার এ সুযোগ এসেছিল রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করতে গিয়ে। এক ভোক্তা নিজে থেকেই দিয়েছিলেন প্রস্তাব। সে সময়ে মাসিক যে বেতন ধার্য করেছিলেন তিনি তা ছিল ওয়েটার হয়ে দৈনিক পাওয়া টিপসের চেয়ে কম। কিন্তু শাখাওয়াত দূরের পথ দেখেছিলেন। তাই কাজ শেখার এ সুযোগ হাতছাড়া করেননি। পড়া শেষে তাই যখন কাজের সময় এলো, তখন বন্ধুদের চেয়ে ছিলেন অভিজ্ঞতায় এগিয়ে।
১৯৮৮ সালে যখন তিনি গ্র্যাজুয়েট হন তখন এক ক্যারিয়ার ফেস্টিভ্যালে একইসঙ্গে তিনটি চাকরির প্রস্তাব পান। সেখান থেকে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের ১৩০ বছরের পুরোনো অডিট ও ট্যাক্স প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারসে সিনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে। ১৯৮৯ সালে শাখাওয়াত আবাস গড়েন ডালাসে। এখনও সেখানেই আছেন। কাজ করেছেন অডিট প্রতিষ্ঠান আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াংয়ের সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে। ঘুরেছেন বহু দেশে, বক্তৃতা দিয়েছেন। কর্মশালা করিয়েছেন তরুণ পেশাজীবীদের।
তথ্যপ্রযুক্তির জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান আইবিএমের গ্লোবাল সার্ভিসেস এনার্জি সেক্টরে এনার্জি অ্যান্ড ইউটিলিটি সার্ভিসেস লিডার এবং প্রিন্সিপাল অ্যান্ড সার্ভিসেস সেলস হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। আইবিএমে কাজ করেন ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। ২০০৫ সালে বিদ্যুতের অপচয় রোধ করার জন্য শাখাওয়াত একটি প্রকল্প শুরু করেন। সাধারণত বিদ্যুৎ স্টেশনে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, বাসাবাড়ি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত যেতে যেতে তার অনেকটা হ্রাস পায়, উৎপাদিত পুরো পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। মাঝখানে কিছু বিদ্যুৎ অপচয় হয়ে যায়। কোনও গাছের ওপর দিয়ে বিদ্যুৎ লাইন গেলে বা লাইনের ওপর কোনও কাক থাকলেও এতে বিদ্যুতের পরিমাণ কমে যায়। এ ধরনের সিস্টেম লস না হওয়ার জন্য শাখাওয়াতের আইডিয়া অনুসারে আইবিএম বৈদ্যুতিক তারের ওপর ডাম্প লাইনের প্রলেপ ব্যবহার করে। বিদ্যুতের অপচয় রোধে সুফল পাওয়ায় ২০০৬ আইবিএম তাকে দেয় ‘প্রেসিডেনশিয়াল অ্যাওয়ার্ড’। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সফটওয়্যারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এনকেসফট। এই প্রতিষ্ঠানটিই তাকে এনে দেয় বিশ্বপরিচিতি।
এনকেসফট চালু করার কারণ হিসেবে জন শাখাওয়াত চৌধুরী বলেন, ‘১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনেটের ব্যবহার কেবল পরিচিতি পাচ্ছে। সেই সময়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিদ্যুৎ এবং গ্যাস বিল জমা দেওয়া (অনলাইন), বিলসংক্রান্ত সমস্যার সমাধান ইন্টারনেটের মাধ্যমে করার আইডিয়া আমি বিদ্যুৎ এবং গ্যাস কোম্পানিগুলোকে দিই। তখন কাস্টমার সার্ভিসগুলোতে সমাধান দেওয়ার জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে একজন কর্মীকে এক ঘণ্টার জন্য ৫ ডলার দেওয়া হতো। আমি তাদের প্রস্তাব দিই, আমাদের সফটওয়্যার ব্যবহার করে যদি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ১০ শতাংশ ব্যক্তিও সেবা নিয়ে থাকেন, তাহলেও কোম্পানি অনেক লাভ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাদার্ন ইউনিয়ন কোম্পানি প্রথম আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে। তারপর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’
জন শাখাওয়াত চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত এনকেসফটের সেবা নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ওরাকল, আমেরিকান এয়ারলাইনস, মেক্সিকোর কিট কারসন, ফিলিপাইনের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মেরিলকো পাওয়ার, ভারতের উইপ্রোসহ বিশ্বের নানা প্রতিষ্ঠান। ব্রাজিল, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের বিদ্যুৎ খাত তার পরামর্শ নিয়মিত নিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, বুলগেরিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া, ভারত ও বাংলাদেশে কাজ করছে এনকেসফট। বাংলাদেশে শুধু গবেষণা এবং উন্নয়নের কাজ করে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এনকেসফটের প্রায় ২০০ কর্মী কাজ করে থাকেন। ২০১৩-১৪ এবং ২০১৪-১৫ সালে পর পর দুই বছর টেক্সাসভিত্তিক বিজনেস জার্নাল ডালাস বিজনেস জার্নাল তাকে প্রদান করে ‘ওয়ান অব দ্য টপ টোয়েন্টি স্মার্ট গ্রিড এক্সপার্টস ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ স্বীকৃতি।
এ স্বীকৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি এই সম্মাননা পেয়েছি যুক্তরাষ্ট্র এবং লাতিন আমেরিকাভুক্ত দেশগুলোর মাঝে। আপনি যদি আমার ক্যাটাগরিতে বিজয়ী অন্যদের নাম দেখেন, আপনি দেখতে পাবেন সে নামগুলো মাল্টিবিলিয়ন ডলার এনার্জি কোম্পানির সিইওদের নাম। এনার্জি কোম্পানিগুলো আমাকে ভোট দিয়েছে, কারণ স্মার্ট এনার্জি তথা গ্রিন এনার্জি, স্মার্ট গ্রিড এসব ক্ষেত্রে আমি উদ্ভাবনী সমাধান দিয়েছিলাম।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান এনকেসফট সফটওয়্যারের মাধ্যমে তিন ধরনের সেবা প্রদান করে। এনকেসফট ওপেন সোর্স সলিউশন নিয়ে কাজ করে। এটি ‘কোলাবরেটিভ কমিউনিকেশন’ সফটওয়্যার এবং এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) সফটওয়্যারের মাঝে সমন্বয় করে, যা সহজে ব্যবহার করা যায় এবং এটি ‘ক্লাউড’ সফটওয়্যারের ভিত্তিতে কাজ করে। পরামর্শ সেবার আওতায় আমরা বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির বিল গ্রহণ, গ্রাহকের কাছ থেকে সেবাসংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ, তথ্য বিশ্লেষণ, সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে দেখভাল ইত্যাদি করে থাকি।
প্রজেক্ট সার্ভিসের আওতায় কোম্পানির যেকোনো ‘প্রজেক্ট বাস্তবায়নে কী কী করণীয়, গুরুত্ব অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যক্তির কাছে প্রয়োজনীয় সময়ে নোটিশ পাঠানো, কোন সমাধান কোথা থেকে আসতে পারে, তা জানিয়ে দেয় এই সার্ভিস। এনসোশ্যাল সার্ভিসের আওতায় কোম্পানির নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রদান করে এনকেসফট।
শাখাওয়াত চৌধুরী ১৭ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানকার ইউনিভার্সিটি অব টালসা থেকে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, দ্য ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে এমবিএ করেছেন। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড আর্কিটেক্টসের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। তিনি তার অর্জিত সব শিক্ষা যেমন কাজে লাগিয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা উদ্ভাবনী কাজে তেমনি তার জ্ঞানের আলো বিনিয়োগ করছেন বাংলাদেশেও।