Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মোদির দিল্লিতে বিচ্ছিন্ন ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়

 

chardike-ad

নিরাপত্তার সন্ধানে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দিল্লিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ২০২০ সালের দাঙ্গার পর থেকে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় বসবাস করতে অনিরাপদ বোধ করছেন মুসলমানরা। তাই তাদের মধ্যে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা ছেড়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রত্যন্ত ও স্বল্প ‍সুবিধাসম্পন্ন এলাকায় সরে যাওয়ার প্রবণতা অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে। শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই খবর জানিয়েছে।

পাঁচজন রিয়েল এস্টেট এজেন্ট, রাজনীতিবিদ, কর্মী ও পুরোহিতসহ প্রায় দুই ডজন মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে রয়টার্স।

খবরে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির দাঙ্গার শিকার নাসরিন ও তার স্বামী তোফিকের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। তখন উত্তর-পূর্ব দিল্লির শিব বিহারে বসবাস করতেন তারা। দাঙ্গার সময় তাদের মতো মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। তোফিক যে ভবনে থাকতেন সেটির দ্বিতীয় তলা থেকে একটি ক্ষুব্ধ জনতা তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছিল। এই ঘটনার কয়েকদিন পরে হাসপাতালে থেকে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। পুলিশ রিপোর্টে এসব তথ্য জানানো হয়।

সে যাত্রায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও একটি পা স্থায়ীভাবে খোঁড়া হয়ে যায় তৌফিকের। এই ঘটনার তিন বছর পর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। এর পর আবারও ফুটপাতে কাপড় বিক্রির কাজে লেগে পড়েন।

দাঙ্গার পরপরই এই দম্পতি আরও প্রত্যন্ত একটি অঞ্চল লোনিতে চলে যান। সেখানে জীবনযাত্রার খুবই নিম্ন এবং চাকরির সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে প্রধান সুবিধা হলো—সেখানে একটি বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী বসবাস করে। রয়টার্সকে তৌফিক বলেন, ‘আমি আর ওই এলাকায় ফিরে যাব না। আমি মুসলমানদের মধ্যে থাকতেই নিরাপদ বোধ করি।’

আপনি সত্যিই কতটা সাহসী হতে পারেন?

রয়টার্স প্রায় দুই ডজন মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে যারা বর্ণনা করেছেন, ২০২০ সালের দাঙ্গা এবং মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা বৃদ্ধির পর কীভাবে মুসলমান সম্প্রদায়রা নিরাপত্তার খুঁজে ভারতের রাজধানীতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন ও প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে সরে যাচ্ছে। এই দাঙ্গার পর দিল্লিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপস্থিতি কার্যকরভাবে অনেক কমে গেছে। যেমনটি এর আগে কখনও দেখা যায়নি।

তবে ভারতের কাছে এই প্রবণতার সরকারি কোনও তথ্য নেই। দেশটির দীর্ঘ বিলম্বিত আদমশুমারির অর্থ হলো, বিগত এক দশকে মুসলিম ছিটমহল কতটা বেড়েছে তার কিছু নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। অথচ ভারতের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশই মুসলিম।

প্রধান প্রতিবেশী জামিয়া নগর দিল্লির ‘গ্রাউন্ড জিরো’ এলাকা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে এটি মুসলমানদের জন্য একটি অস্থায়ী প্রধান এলাকা ছিল।

রাজনীতিবিদ, অ্যাক্টিভিস্ট, পুরোহিত ও পাঁচ রিয়েল-এস্টেট এজেন্টসহ ১০জন স্থানীয় নেতা জানিয়েছেন, আশেপাশের এলাকায় মুসলিমদের ভিড় এতটাই বেশি যে দ্রুত আরও বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করা সত্ত্বেও সেখানে তাদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না।

দক্ষিণ দিল্লির রিয়েল এস্টেট এজেন্ট রইস খান বলেন, ‘একজন মুসলিম যতই সাহসী হোক না কেন তারা মনে করেন, তাদের সরে যেতেই হবে। কেননা, একটি জনতা এসে যদি হামলে পড়ে তখন আপনি সত্যিই কতটা সাহসী হতে পারেন?’

তিনি জানান, মুসলিম ক্লায়েন্টরা এখন প্রায় একচেটিয়াভাবে জামিয়া নগরের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় বাড়ি চায়।

মোদি সরকার ও ভারতে ইসলামবিদ্বেষ বৃদ্ধি

গত দশকে জাতীয়ভাবে মুসলিমদের এই বিচ্ছিন্নতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানী রাফেল সুসেউইন্ড। তিনি ভারতের মুসলিম জনসংখ্যার নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ফিল্ড-ওয়ার্ক তত্ত্বাবধান করেছেন।

এই প্রবণতার পেছনে একটি ‘মূল চালক’ মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)-এর অধীনে ক্রমবর্ধমান ইসলামবিদ্বেষ। ২০১৪ সালে ভারতের ক্ষমতায় আসে বিজেপি।

মুসলিম সম্প্রদায়ের ছয়জন নেতা বলেছেন, সুসেউইন্ড বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধির যে দাবি করেছেন সেগুলোকে সমর্থন করে এমন উল্লেখযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। জামিয়া নগরের ধর্মীয় নেতা মোঃ সাহিল বলেছেন, তার মসজিদে ফজরের নামাজে মুসল্লিদের উপস্থিতির সংখ্যা গত চার থেকে পাঁচ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ৪৫০-এর বেশি হয়েছে। এটি সেখানে জনসংখ্যার সামগ্রিক বৃদ্ধিকেই প্রতিফলিত করে।

ঘৃণাত্মক বক্তৃতা বৃদ্ধি

ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো একটি সরকারি সংস্থা, যেটি অপরাধের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে। সংস্থাটি সম্প্রদায়গুলোর ওপর হওয়া নির্দিষ্ট সহিংসতার রেকর্ড রাখে না। এটি বলেছে, কংগ্রেস পার্টির শাসনামলে, আগের নয় বছরের তুলনায় ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সাম্প্রদায়িকসহ বার্ষিক দাঙ্গার গড় সংখ্যা প্রায় ৯ শতাংশ কমেছে।

তবে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিংক-ট্যাংক ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব অর্গানাইজড হেইট’-এর স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা ২০২৩ সালে মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি নথিভুক্ত করেছেন। প্রথম ৬ মাসে এ ধরণের ২৫৫টি এবং দ্বিতীয় ৬ মাসে ৪১৩টি ঘটনা নথিভুক্ত করেন তারা। এই প্রবণতার মূলে বিজেপির রাজনীতিবিদ ও সহযোগী গোষ্ঠীগুলো ছিল বলেও জানায় থিংক-ট্যাংক।

এর আগে, এক প্রতিবেদনে রয়টার্স জানিয়েছিল, কীভাবে বিজেপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডানপন্থি ‘গো-মাতা রক্ষাকারীরা’ মুসলমানদের ওপর হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছে।

এপ্রিলে তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রচারণা চালানোর সময় মুসলমানদেরকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে আক্রমণ করেছিলেন মোদি। এসময় তিনি তাদের ‘আরও সন্তান’ রয়েছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন, যার অর্থ ছিল, তারা ভারতের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য হুমকি।

বিজেপির সিদ্দিকী আরও বলেন, মোদি রোহিঙ্গা মুসলিমদের মতো নথিভুক্ত অভিবাসীদের কথা বলছেন, যাদের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ, রোহিঙ্গার ‘ভারতে বসবাস করছে এবং ভারতকে দুর্বল করছে।’

পূর্বে কথিত মুসলিমবিরোধী পক্ষপাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে বিজেপি সরকার বলে, দলটি বৈষম্য করে না এবং তাদের অনেক দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচি মুসলমানদের উপকার করেছে, যারা ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে।

বেসরকারি অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস ৫ জুলাই জানিয়েছে, জুনে জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর বিজেপি একটি ভঙ্গুর জোট সরকার গঠন করে। এর পর অবিলম্বে অন্তত আটটি মুসলিমবিরোধী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে।