খোকন চন্দ্র বর্মণের ওপরের ঠোঁট, মাড়ি, নাক, তালু—এগুলোর এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বলা যায়, সেখানে বড় একটি গর্ত হয়ে আছে। ২৩ বছর বয়সী এই তরুণের এক চোখ প্রায় বন্ধ। সে চোখে কিছু দেখেন না তিনি। আরেক চোখ কোনোভাবে টিকে আছে। তবে এ চোখেও আবছা দেখেন। তাঁর দুই পায়ে গুলি রয়ে গেছে।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি চলাকালে গত ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন পেশায় গাড়িচালক খোকন। কাছ থেকে পুলিশের ছোড়া গুলিতে তাঁর এ অবস্থা হয়েছে।
খোকন নিজের শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে খুব সচেতন ছিলেন। বিশেষ করে মুখে যাতে কোনো দাগ না পড়ে, তা নিয়ে তাঁর সচেতনতার শেষ ছিল না। অথচ এখন তিনি তাঁর চেহারা দেখে নিজেই ভয় পান।
খোকনের জিব তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তিনি যখন কথা বলেন, তখন মুখের গর্ত দিয়ে জিবের নড়াচড়া বোঝা যায়। তবে তাঁর কথা বেশ অস্পষ্ট। কিছুক্ষণ শোনার পর বোঝা যায়, তিনি কী বলতে চাচ্ছেন।
৫ আগস্ট কী ঘটেছিল, তা বলতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন খোকন। তাঁর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। পরে তাঁকে বলা হয়, তিনি পুরোপুরি সুস্থ হলে তখন সেদিনের ঘটনার বিবরণ শোনা যাবে।
গত সোমবার রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের শয্যায় বসে খোকন বলেন, তিনি হাসপাতালের শৌচাগারে গিয়ে বড় আয়নায় প্রথম যেদিন নিজের চেহারা দেখেন, সেদিন খুব ভয় পেয়ে যান। এখনো আয়নার সামনে গিয়ে কান্না আটকাতে পারেন না তিনি। তাঁকে দেখে অন্যরা যাতে ভয় না পান, সে বিষয়েও তিনি সতর্ক থাকেন।
বিদেশে নেওয়ার জন্য খোকনের পাসপোর্ট করতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে বলে জানান তানভীর আহমেদ। তিনি বলেন, তাঁর এখনকার চেহারা দিয়ে পাসপোর্ট করা সম্ভব নয়। তাই সরকারের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে তাঁর আগের ছবি দিয়েই পাসপোর্ট বানাতে হয়েছে।
হাসপাতালের শয্যায় থাকা খোকনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর মা রীনা রানী দাস। তিনি বলেন, ‘মা হয়ে নিজেই চিনতে পারি না ছেলেকে। কী সুন্দর ছিল আমার ছেলেটা। বাবুগিরি কইরা বেড়াইত। সব সময় চেষ্টা করত মুখের মধ্যে কোনো দাগ যেন না লাগে। সেই ছেলের কী চেহারা হইল। মা, তাই ছেলেরে দেখে ভয় পাই না। কিন্তু ছেলে নিজের চেহারা আয়নায় দেখে কান্নাকাটি করে। ও তো আন্দোলনে গেসিল। সরকার তাড়াতাড়ি ওরে একটু ভালো করে দিতে পারে না?’
খোকনের বড় ভাই খোকা চন্দ্র বর্মণও পেশায় গাড়িচালক। তিনি ও খোকন একই কোম্পানিতে গাড়ি চালাতেন। দুই ভাই মাসে প্রায় ১৯ হাজার টাকা করে বেতন পেতেন। খোকন যাত্রাবাড়ীতেই থাকতেন। আর খোকা মা-বাবা ও ছোট ভাইকে নিয়ে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে থাকেন।
৫ আগস্টের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গুলিতে খোকনের পুরো মুখের মাংস প্রায় খুলে খুলে পড়ছে। তাঁর পুরো শরীর রক্তাক্ত। এ অবস্থাতেও তিনি একজনের হাত ধরে উঠে দাঁড়ান।
খোকা জানান, গুলি লাগার পরও খোকনের জ্ঞান ছিল বলে তিনি পরে জেনেছেন। খোকন নিজেই আঙুলের ছাপ দিয়ে মুঠোফোনের লক খোলেন। সেই মুঠোফোন থেকেই একজন তাঁকে (খোকা) খোকনের গুলি লাগার খবর জানান।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে খোকা যে অবস্থায় খোকনকে দেখেছিলেন, তাতে তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর ভাই আর বাঁচবেন না। তাই খোকনের বেঁচে থাকাটা এই পরিবারের কাছে তাঁর নতুন জীবন পাওয়ার মতোই মনে হচ্ছে।