Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

mosjidপ্রায় সাত হাজার ৮২৭.৪ বর্গমাইল আয়তনের ছোট্ট দেশ স্লোভেনিয়া। মধ্য ইউরোপের দেশটির জনসংখ্যা ২০ লাখের কাছাকাছি। তাদের মধ্যে শতকরা তিন দশমিক সাত ভাগের মতো মুসলিম। ক্যাথলিক খ্রিস্টানিটির পর দেশটির সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের ধর্ম।

দেশটির মুসলিম জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ সদস্যই মূলত বসনিয়ান ও আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত। যদিও দেশটির দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম, কিন্তু দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে দেশটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মসজিদ ছিল না।

chardike-ad

ভৌগোলিক শ্রেণিবিন্যাসের দিক থেকে স্লোভেনিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া, বুলগেরিয়া— এসব দেশে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা ‘সাউদার্ন স্লাভ’ নামে পরিচিত। ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যতার জন্য স্লোভেনিয়াতে অনেক আগে থেকেই আশপাশের দেশ অর্থাৎ বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়ার অধিবাসীদের যাতায়াত রয়েছে। এছাড়া যুগোস্লাভ যুদ্ধের সময় বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা এবং আলবেনিয়া (প্রকৃতপক্ষে কসোভো) থেকে একটা বড় অংশের মানুষ ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে স্লোভেনিয়াতে পাড়ি জমান। এসব বসনিয়ান ও আলবেনিয়ান ইমিগ্র্যান্টের মাধ্যমেই দেশটিতে মূলত ইসলামের বিস্তার ঘটে। এছাড়া বর্তমানে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকেও অনেকে স্লোভেনিয়াতে উচ্চশিক্ষা কিংবা অভিবাসনের আশায় পাড়ি জমাচ্ছেন, যাদের একটি অংশের মানুষের ধর্ম ইসলাম।

স্লোভেনিয়াতে প্রথম মসজিদ নির্মাণের কথা জানা যায় ১৯১৬ সালে। সেসময় দেশটি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান শাসনের অধীনে ছিল। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান শাসকদের অধীনে কাজ করা একদল বসনিয়ান সৈন্য স্লোভেনিয়ার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি ছোট গ্রাম লগ পড ম্যানগারটোমেতে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন যা ‘লগ পড ম্যানগারটোম মসজিদ’ নামে পরিচিত। তবে এর চার বছর পর অর্থাৎ ১৯২০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মসজিদটি বন্ধ করে দেয়া হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা মিলে যুগোস্লাভিয়া গঠন করে। যুগোস্লাভিয়ার মধ্যে আলবেনিয়ার একটি অংশ ছিল যা আজকের দিনে ‘কসোভো’ নামে পরিচিত। আসলে কসোভো হচ্ছে একসময় সার্বিয়ার দখলে থাকা আলবেনীয় অংশ। স্বাভাবিকভাবে একই দেশের অংশ হওয়ায় এসব দেশের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যাতায়াত বিদ্যমান ছিল।

১৯৬৯ সালে প্রথম স্লোভেনিয়ার তৎকালীন স্থানীয় সরকারকে অনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানানো হয় দেশটির রাজধানী লুবলিয়ানাতে একটি মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেয়ার জন্য। যুগোস্লাভিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে স্লোভেনিয়াতে আসা মুসলমানদের পক্ষ থেকে এ অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের বিরোধের মুখে সে প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি।

১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়ার পতন ঘটলে এবং দেশটি থেকে আলাদা হয়ে নতুন একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রেও একটি মসজিদ বানানোর অনুমতি চেয়ে দেশটির সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। কিন্তু স্লোভেনিয়ার সরকার সেসময় তাদের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিকতার কথা বলে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি প্রদান থেকে বিরত থাকে। দেশটির অতি ডানপন্থী কিছু রাজনৈতিক নেতাদের বিরোধিতার কারণে দীর্ঘদিন তাদের এ প্রস্তাবনা আলোর মুখ দেখেনি।

২০০৪ সালে প্রায় তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার ইউরোর বিনিময়ে লুবলিয়ানাতে অবস্থিত সেস্টা ডিভেহ সেসারিয়েভ (Cesta dveh cesarjev) নামক জায়গায় স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত মুসলিম কমিউনিটির পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম দুই হাজার ৮০০ মিটার জমির বরাদ্দ চাওয়া হয় মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্যে। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে সেস্টা ডিভেহ সেসারিয়েভের পরিবর্তে কুরিলনিস্কা ও পারমোভা নামক সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে একটি প্লট বরাদ্দ চাওয়া হয় মসজিদটি নির্মাণ করতে। কিন্তু দুবারই স্থানীয় সিটি কর্পোরেশন কাউন্সিলের বিরোধিতার কারণে এ প্রস্তাবনা ঝুলে থাকতে আরম্ভ করে। যদিও লুবলিয়ানার প্রাক্তন মেয়র জোরান জাঙ্কোভিচ বরাবরই মসজিদ নির্মাণের পক্ষে তার মতামত প্রকাশ করে আসছিলেন। বিশেষ করে মসজিদের প্রাথমিক নকশায় ৪০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট মিনার বা গম্বুজের কথা বলা হয়েছিল যা দেশটির অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভালোভাবে নেয়নি।

২০১৩ সালে দেশটির জাতীয় সংসদে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেয়া নিয়ে এক বিতর্কের সূত্রপাত হয়। যেখানে দেখা যায়, দেশটিতে বামপন্থী ও লিবারেল ফ্রন্ট নামে পরিচিত লিবারেল ডেমোক্রেসি অব স্লোভেনিয়া ও জারেস সোশ্যাল লিবারেল পার্টির সদস্যরা এ প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন দিলেও অতি ডানপন্থী ও রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত স্লোভেনিয়ান ন্যাশনাল পার্টির সদস্যরা এ দাবির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস, ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব পেনশোনারস অব স্লোভেনিয়া এবং স্লোভেনিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতিনিধিরা সরাসরিভাবে প্রস্তাবের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে প্রত্যক্ষভাবে কোনো মতামত উল্লেখ না করে একধরনের মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছিলেন।

২০১৩ সালে এ মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হলেও ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে এসে নির্মাণকাজ শেষ হয়। মাঝখানে ২০১৭ সালে এসে আবারও মসজিদের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে মসজিদটি নামাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

মসজিদটি নির্মাণ করতে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ইউরোর খরচ হয়, যার মধ্যে প্রায় ২৮ মিলিয়ন ইউরোর মতো খরচ একাই বহন করে কাতার। মসজিদের ভেতরের নকশা করা হয় তুরস্ক অর্থাৎ উসমানী খিলাফতের এক সময়কার রাজধানী হিসেবে পরিচিত ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত সুলতান আহমেদ মসজিদের অনুসরণে। একসাথে এক হাজার ৪০০ মানুষ এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারবেন।

প্রাথমিকভাবে মসজিদটি ‘লুবলিয়ানা মসজিদ’ নামেই পরিচিত এবং এটির অবস্থান লুবলিয়ানার অধীন শিস্কাতে। মসজিদের পাশাপাশি এ স্থানে রয়েছে স্লোভেনিয়ার ইসলামিক কমিউনিটির প্রধান অফিস, লাইব্রেরি, জিম, রেস্টুরেন্ট, একটি ইসলামিক স্কুল এবং বসবাসের জন্য একটি রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স।

স্লোভেনিয়ান টাইমস পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে পরিচিত নেদজাদ গ্রাবুস বলেছেন, মসজিদটি স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত মুসলমানদের জীবনে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। এখানে বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষের ধর্মচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লেখক, শিক্ষার্থী দ্বিতীয় বর্ষ, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।