Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

nur-alam-japanশীত আর বরফে ঢাকা এক ভোরে অজানা এক দ্বীপে এসেছিলাম সঙ্গে ছিল আরো দু জন। শীতের শ্রুভ্রতা আর বাতাসের তীব্র বেগে শরীর যেন জড়াতে চায় আরো মোটা কাপড়।সমুদ্রের তীরে পূর্ব চায়না সাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরের বুক চিরে জন্ম নিয়েছে সেই দ্বীপ ,পাহাড়, সমুদ্র প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠা এখানকার মানুষ গুলো সত্যি অসাধারণ !আছে নিজস্ব সংস্কৃতি ,হাজার বছরের সভ্যতা, ইতিহাস। সেখানে শুরু তা ছিল এমনই, নতুন খাদ্যাভ্যাস, নতুন কর্ম পরিবেশ, সব কিছুতেই যেন অজানা এক আতঙ্ক!

খানিকটা সময় লেগেছে নিজেকে মানিয়ে নিতে, সাথে শুনতে হয়েছে কত কথা,গালাগাল একটা নিত্তনৈমত্তিক ব্যাপার। তবু এতটুকুও ক্ষান্ত হয়নি ,লেগেই ছিলাম আছি, এখনো। ক্লান্ত তবে কাজ শেষে সবার হৃদয় নিগড়ানো হাসিতে ভুলে যাই পূর্বের বিষকথা। সময় পেলেই উৎসব-পার্টি মিস করিনা কখনোই। দেখছি এবং শিখতেছি জাপানিজদের কর্মের দৃঢ়তা,সময়ের মান্যতা, আর অবসর সময় জীবন উপভোগ করার মহেন্দ্রক্ষণ।

chardike-ad

ভালোবাসার ওপর নাম ভালোরাখা, বেঁচে থাকার ওপর নাম কর্ম ,আর বর্ণিল কর্মময় জীবনই পুরুষ সভ্যতার হাতিয়ার। প্রতিদিন কর্মময় জীবনে ছুটে চলা আর কোম্পানি তে সবার ছোট হওয়ায়, আর কাজ না পারায় সিনিয়র দের বকাবকি, দুষ্টামি ভাবেই চলে জাপানের দিনলিপি…

কাজের মধ্যবিরতিতে একদিন জানতে পারলাম নতুন একজন সহকর্মী কোম্পানিতে যোগদান করবে, আমাদের গাড়িতে করেই একসাথে যাওয়া আসা করবে। শুনার পর কেন জানি একটু ভালো লাগা কাজ করলো, আমার উপর চাপটা একটু কমবে মনে হয় এইভেবেই। নতুন সহকর্মীকে স্বাগত জানানোর জন্য আগামীকাল এর প্রতীক্ষায় রইলাম….

সে দিনটার কথা খুব আবছা আবছা মনে পড়তেছে, সিটি অফিস এর সামনে আগন্তক এক চিকনা মাঝারি শরীর, মাথায় রুমাল পেঁচানো দাঁড়িয়ে আছে ,বুঝতে বাকি রইলোনা সেই আমাদের নতুন সহকর্মী। শুরুতে মনে আছে, সকালের অভিবাদন দিয়েই আমাদের কথোপকথন শুরু করছিলাম এর পর আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্কটা এত গভীর হবে ,এত কম সময়ে কল্পনাও করতে পারিনি। সমবয়সী আর কাজে এখনো অভিজ্ঞ না হওয়ায় আমার সাথে তার মিল অনেক। আর সময়সময় একসাথে কাজ।

প্রসঙ্গতঃ জাপানে কাজের সীমানায় বয়সে বড় হলেও যে অভিজ্ঞ তাকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। আহ, যার প্রসঙ্গে এত কথা সেই আমার বন্ধু নামটায় বলা হয়নি ,তার নাম হারুকি ,খুবু হারুকি। সে কাজে এখনো অভিজ্ঞ না হওয়ায় কিছু না পারলেও ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ঠিকই সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতো ,যা আমি প্রথমে পারতাম না।

এরই মধ্যে কিছুদিন হলো হারুকি সান বাসা পরিবর্তন করেছে। নতুন বাসার অল্প দূরত্বে ঠিক পার্কের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকত সকালে পিক আপ টাইম এ কালো সান গ্লাস কানে হেড ফোন লাগানো হারুকি সান। হারুকির বয়স ২৮ ছুঁই ছুঁই ,এরই মধ্যে বিয়ে করে ফেলেছে ,মায়ামিচান তার বউ, তার বয়স ২১ এত সুন্দর couple চক্ষু শীতল করার মতো। ১০ বছর ফুকুওয়াকে তে কাজ করছে হারুকি সান ,সেখানেই তাদের পরিচয় ,শেষত পরিণয়। এখন বাকিটা সময় আমাদের এই শহরেই থাকবে স্থির করেছে।

আমার মনের ভিতর কেন জানি ভাবনায় আসত হারুকি হয়তো বেশিদিন আমাদের সাথে কাজ করবেন না ,এটা কেন আসত ভাবনায় আমি বলতে পারবোনা। আমি মাঝে মাঝে দূর থেকে লক্ষ্য করতাম কোম্পানির কোনো পার্টি তে খাবারের সময় নিজে খেয়ে ওকসান এর জন্যও নিয়ে যেত ,যেটা অন্য কারো কাছে দেখতাম না কখনো। এইতো কিছুদিন আগে একটা ট্রাভেল ম্যাপ দেখতেছি, ছুটির দিন কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় সেই ভেবে, হারুকি সান সেই ম্যাপ দেখে বললো ওকসান মানে বউ খুব খুশি হবে এটা পাইলে, তুমি আমাকে এটা দিও ,এটা দেখে ছুটিতে ঘুরতে যাবো আমরা ,বলা মাত্র সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলাম মাপটি।

মাঝে মাঝে হারুকি কে জিজ্ঞাস করতাম বৌ কে কেমন ভালোবাসো ? বলল দেখো হোসাইন জাপানিজরা বিয়ের পরও অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করে কিন্তু আমি করিনা ,আমাদের ভালোবাসার সাথে মৃত্যুটাও যেন এক সাথে হয়।

কারাওকে জাপানিজ বারে অসাধারণ গান করতো। আর তার বিয়ারের কাপে নিজে চুমু দিয়ে বিয়ার পান করা -সম্পর্কটা কতটা গভীর তারই প্রমান। আজ শনিবার সপ্তাহের শেষ দিন ,স্বভাবতই কাজ শেষ এ এক সাথে ফেরা। সেই চিরচেনা গলি আর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে আসা হারুকির শেষ দৃশ্য এটাই এতটুকুও বুঝতে পারিনি।

রবিবার ছুটি শেষ এ সোমবার শুনলাম হারুকির ওকসান খুব অসুস্থ হাসপাতাল এ আজ কোম্পানিতে আসতে পারবেনা ,আগামীকাল থেকে আসবে। সেই কথা মঙ্গল বার যথাসময়ে সকালে পার্কের সামনে গাড়ি নিয়ে, হারুকি নেই অপেক্ষা আরো ৩০ মিনিট ,বাসার গলি চিনি ,বাসা চিনি না,আর আগানো গেলোনা

ফিরে আসলাম কোম্পানিতে, যথারীতি কাজে…….

বুধবার সকালে জানতে পারলাম হারুকির বাসার গলিতে এক দম্পত্তি আগুনে পুড়ে মারা গেছে। এক অজানা শঙ্কায় পড়লাম সবাই এদিকে হারুকির ফোন অফ তারও খোঁজ নেই ,মারা যাওয়া দম্পত্তি কি হারুকির! কেমন জানি আশঙ্কা আমাদের মাঝে।

হারুকির কাজের পোশাক এক সাথেই থাকতো , তার পোশাক হাতে নিয়ে একজনকে বলতে দেখলাম হারুকি গাম্বাততে…..তুমি যেন না হও সেই মৃত্যু ব্যক্তি। মানুষের আবেগ দেখেছি ,তবে এভাবে কাউকে মিস করা এটাই প্রথম দেখলাম। সন্ধ্যা নামতেই হারুকির বাসার সামনে দেখলাম পুলিশ ,আর বুঝতে বাকি রইলো না আগুনে পুড়ে মৃত দম্পত্তি হারুকি সান এর। মেনে নেয়ার মতো না ,এভাবে তাজা দুটি প্রাণ ঝরে গেলো,মেনে নেয়া কষ্টের।

গেছিলাম হারুকিসান আর শেষকৃত্যে, দেখলাম বৃদ্ধ বয়সী পিতা অপলক তাকিয়ে আছে ,কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে,আমি আসছি খুব খুশি হয়েছে। দেখলাম হারুকি সান এর নিথর দেহ কফিনে মোড়ানো, জানতে পারলাম আগুনে নয় আত্মহত্যাই করেছে দুইজন। ভালোবাসার নিখাত পরীক্ষাটাও শেষ অবধি দিয়েছে দুজন।

আজ অনেকদিন হলো হারুকি নেই ,আমরা আমাদের মতো কাজ করি। মাঝে মাঝে ভুল করে হারুকিকে খুঁজি কাজের ভিতরে ,মাঝে মাঝে মনে হয় পিছন থেকে হারুকি সেনপাই সেনপাই বড়ভাই বড় ভাই বড় বলে ডাকতেছে আমাকে।  এক সাথে অন্য কোনো সেনপাই এর বদনাম করতেছি দুজনেই আর হাসা হাঁসি করতেছি !

আজ হঠাৎ করে মোবাইল চাপতে চাপতে হারুকির লাইন আইডি তে চোখ পড়লো ,সেই নতুন বছরের মেসেজ ,নতুন বছর ভালো হবার প্রত্যয়ের মেসেজ। হারুকি তোমার প্রত্যাশায় আমি আছি ,নতুন বছর নতুন করেই যাচ্ছে দীপ্তশপথে, আর আমার ফিরতি

মেসেজ এ তোমার শুভ কামনার সেই তুমি নেই…… এমনিভাবে হারুকি গেলো ,আমিও যাবো। রয়ে যাবে কিছু আবেগ মাখানো স্মৃতি। বহু বছর পর সাত সাগর পাড়ি দিয়ে আবার আমার গ্রামে ফিরে যাবো ,গ্রামের পাশে বহতা নদীর তীরে বসে স্মৃতিচারণে হয়তো তুমিই থাকবে, সেই খেয়াল গুলো ধরা দিবে স্মৃতি পটে।

হারুকিরা এক মায়ার নাম, ভিনদেশি তবু রক্তে মাংসে মানুষ তো, এজন্যই মনে হয় মন কাঁদে ,সবাই সবার হারুকি বন্ধু হতে পারেনা। বন্ধুত্ব এক অমূল্য দান ,যা হারুকির মহাপ্রয়াণে বুঝতে পেরেছি ,মিস ইউ হারুকি !!!!!!

লেখক- নূর আলম, জাপান থেকে