Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

probasবিদেশ যাওয়ার জন্য ট্রেনিং, ভিসা থেকে শুরু করে সবকিছুই ঠিকঠাক। এরপর শুরু করলাম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা। পোশাক-আশাকের প্রতি আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। ভাবলাম কয়টা মাত্র জামা-কাপড়, লুঙ্গি-গামছা আর শুকনো খাবার নিলেই যথেষ্ট। জমকালো কোনো আয়োজনের প্রয়োজন নেই। এরপরও মা আমাকে না বলে গোপনে ওষুধ, জামা-কাপড়, সেভিং ক্রিম, শুকনো খাবার, পছন্দের পিঠা, নারিকেলের নাড়ু বানিয়ে ব্যাগে ভরে দিয়েছে। যেটা আমি সিঙ্গাপুরে এসে বুঝতে পেরেছি।

মা আমার পছন্দের খাবার সবই জানতো তারপরও আমাকে জিজ্ঞেস করত তুই কী খাবি? আমি বলতাম, তোমরা যা খাও আমিও তাই খাব। তবুও জিজ্ঞেস করত। কি আর করার, আমি খাবারের নাম বলে দিলাম যে খাবার আমাদের পরিবারের সবাই খেয়ে থাকে। মা সেই অনুযায়ী খাবার রান্না করতেন।

chardike-ad

খেতে বসার আগে বোনের সাথে একপশলা ঝগড়া লেগে গেল। মা গলদা চিংড়ি ভুনা করে টেবিলের উপর বড় বাটিতে রেখে দিয়েছে। আমি ঘরে যাবার সময় দেখি বড় গলদা চিংড়ির টুকরো মনে হচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কারোর দিকে না তাকিয়ে খেয়ে নিলাম দুই টুকরো। ঘর থেকে বোন আমার খাওয়া দেখে মা মা করতে করতে চিৎকার করে উঠল।

বোন বলল, তুই হাত না ধুয়ে চিংড়ি মাছ খেয়েছিস কেন? আমি এই তরকারি খাব না। আমি বললাম যাক তোর যদি খেতে ইচ্ছা না হয়, তাহলে আমি খাব। সাথে সাথে খেয়ে নিলাম আরেক টুকরো। বোনের মন খারাপ দেখে মা বলল, তোকে আলাদাভাবে রান্না করে দেব, আজ অন্য তরকারি দিয়ে খা। বোন রেগে গরগর করে কিছুক্ষণ পর ঠান্ডা হয়ে গেল।

আমাদের বাসায় রান্নার পর সবাই তেমন একসাথে খাওয়া হত না। সিঙ্গাপুরে আসার আগে তখন কেন জানি মনে হতো সবাই মিলে অন্তত যাবার আগে প্রতিদিন একসাথে খাব। যাবার আগে কয়টা দিন আমাকে শান্ত হতে হবে। কারণ, আমার খাওয়ার কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না। আমি কারোর জন্য অপেক্ষা করতাম না। ক্ষুধা লাগলেই খেয়ে নিতাম। পরিবারের সবাই মিলে একসাথে খাওয়ার সেই যে কিসের যেন একটা ইচ্ছা আর টান ছিল, সেই টানের গভীরের উত্তর জানার দুঃসাধ্য আজও হলো না।

খাবার শুরু করার পর থালার উপর ভাতই খুঁজে পেতাম না! শুধু তরকারিতে ভরপুর। জিজ্ঞেস করতাম এত তরকারি কেন, আমি ভাত খাব না-কি তরকারি খাব? মা বলতো খা তো, আর কয়দিন আছিস। আমি তরকারি উঠিয়ে ছোট বোনের থালায় দিতাম। বোন বলতো, ভাইয়্যা তুই আমাকে দিচ্ছিস কেন। তুই খা। আমি খাব না। মা বলতো ভাইয়া দিয়েছে খা। রাগ করিস না। তোর ভাই তো আর কয়দিন পর চলে যাবে তখন তো আর কেউ তোর থালার উপর তরকারি দেবে না। তখন কার সাথে ঝগড়া করবি? মার কথা শুনে বোন আর কিছুই বলত না।

বিনা কারণে বোনের সাথে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকত। নিজের খাবার খেয়ে বোনের খাবার থেকে খেয়ে ফেলতাম। মাঝে মধ্যে দুই-একটা কিল-ঘুষিও চলত। বোনের কান্না শুনে মা আমাকে বকাঝকা করত। মা বলত, এত বড় হয়েছিস এখনও তোর খুনসুটি ভাব গেল না। মা’র কথা কে আর শুনত। কিছুক্ষণ চুপচাপ তারপর আবার যা তাই।

আসার আগে বোনের সাথে আমার যত খুনসুটির মায়াজাল বিছিয়ে ছিল সবই ধীরে ধীরে ঘুছিয়ে নিতে শুরু করলাম। জানি সব মায়া ঘুছিয়ে নেওয়া যায় না। তারপরও গোপনে হৃদয় না ভাঙার মিথ্যা চেষ্টা করতাম। বোনের সাথে আর খুনসুটি করতে পারব না ভেবে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।

আমার একটা বদ অভ্যাস ছিল। খাওয়ার পর মায়ের কাপড়ের আঁচলে মুখ মোছা। আসার কয়দিন আগে থেকে মুখ মোছা বন্ধ করে দিলাম। খাবার পর তাড়াহুড়ো করে বাহিরে চলে যেতাম। মা বলতো এত তাড়াহুড়ো করিস কেন? আমি বলতাম বন্ধুদের সাথে একটু দেখা করতে যাব, দেরি হয়ে যাচ্ছে। মা বলতো, আর কয়দিন পর চলে যাবি, আমাদের সাথে বসে কয়ডা খা।

আমি মায়ের কথা শুনতাম না। যদি মায়ের কথা শুনি তাহলে খাবার পর কাপড়ের আঁচলে মুখ মুছতে হবে। কিন্তু, এই অভ্যাস যে আমাকে ছাড়তেই হবে। মার কথা শুনলে হঠাৎ করে আমার অভ্যাস পরিবর্তন করতে কষ্ট হবে। সেজন্য তাড়াহুড়োর ভাব দেখিয়ে মিথ্যা বলে বাহিরে চলে যেতাম। মা বলতো আর কয়দিন পর বিদেশে চলে যাবি, সবসময় তো আর বাধা দিতে পারব না। যে কয়টা দিন আছিস, যেভাবে চলতে ইচ্ছে চল। তখন আমি খুশি হতাম। সেটা ছিল মানুষ দেখানো খুশি।

প্রিয়জনদের ছেড়ে যাওয়ার মায়ায় আমার ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যেত। সেই গোপন আগুনে পোড়া ছিল খুবই কষ্টের। আমি সবই বুঝতাম, কিন্তু তখন যদি মায়া-মমতা ত্যাগের অভ্যাস না করতাম, তাহলে কীভাবে একা-একা প্রবাসে দিন কাটাব। তখন আমার মুখের গঠনে হাসির ছাপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতাম।

এই যে এতটা বছর, দিন। খাবার পর মায়ের আঁচলে মুখ মুছি না। তাতে কি, আমার দিন বুঝি কাটছে না? তবুও দিন কাটছে। আমার মতো আরও অনেক প্রবাসীর সময়ের উপর নির্ভর করে আমাদের চলতে হয়। সময় পৃথিবীর সকল অস্তিত্ব ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। সেই টুকরো অস্তিত্ব হৃদয়ে ধারণ করে সবকিছু মেনে নিয়েই আগামীকালের স্বপ্ন দেখতে হয়। স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখাই। কখনো কখনো এই প্রবাসে, তুমুল স্বপ্ন বিলাসী হয়ে উঠি।