যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া ৪০০ পৃষ্ঠারও বেশি অভ্যন্তরীণ সরকারি দলিলগুলোতে চীনের উইঘুর মুসলিমদের আটকের বিষয়ে মূল বিবরণ প্রকাশ হয়েছে। সরকারি ওই দলিলগুলোতে দেখা যায় যে চীনের জিনজিয়াং রাজ্যে প্রায় ১০ লাখ উইঘুর, কাজাখ এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর চীনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন করা হয়।
চীনে প্রায় দেড় কোটি উইঘুর মুসলমানের বাস। জিনজিয়াং প্রদেশের জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশই উইঘুর মুসলিম। এই প্রদেশটি তিব্বতের মতো স্বশাসিত একটি অঞ্চল। বিদেশি মিডিয়ার সেখানে প্রবেশের ব্যাপারে কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সূত্রে খবর আসছে, সেখানে বসবাসরত উইঘুরসহ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড় চালাচ্ছে বেইজিং।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তা দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছেন, জিনজিয়াং-এর বিভিন্ন বন্দিশিবিরে অন্তত ১০ লাখ মুসলিমকে আটক করে রেখেছে চীন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোও জাতিসংঘের কাছে এ ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে। তবে চীন বরাবরই মুসলিমদের গণগ্রেফতারের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের হাতে আসা দলিলটি চীনের একজন ঊর্ধ্বতন রাজনীতিকের কাছ থেকে ফাঁস হয়েছে। এতে দেখা গেছে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কীভাবে ২০১৪ সালে অঞ্চলটি সফরকালে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে অঞ্চলটির মুসলিমদের ব্যাপারে বেইজিং-এর অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।
একটি ট্রেন স্টেশনে ছুরি হামলার পর অঞ্চলটি সফর করেন শি জিনপিং। ওই হামলার জন্য উইঘুরদের দায়ী করা হয়ে থাকে। এরপর দেয়া সিরিজ ভাষণে একনায়কতন্ত্রের উপাদানগুলো ব্যবহার করে ‘সন্ত্রাসবাদ, অনুপ্রবেশ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে’ লড়াইয়ের নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে কোনোভাবেই অনুকম্পা না দেখানোর নির্দেশ দেন তিনি।
চীনা প্রেসিডেন্টের এমন নির্দেশের ব্যাপারে রয়টার্সের পক্ষ থেকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি ফ্যাক্স করা হয়েছে। এর কোনো জবাব মেলেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, চীনের লড়াই কথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নয় বরং জিনজিয়াং থেকে উইঘুর মুসলমানদের অস্তিত্ব মুছে ফেলার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে বেইজিং।
দলিলগুলোতে দেখা যায়, অন্যান্য দেশে সন্ত্রাসী হামলা এবং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের ফলে চীনা নেতৃত্বের ভয় আরো বেড়েছে। বন্দিশিবিরে নিয়ে যাওয়া মুসলিম পরিবারের কোনো সন্তান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরলে কর্মকর্তারা তাদের জানাতেন, তার পরিবারের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য নেয়া হয়েছে।
চীনা কর্মকর্তারা মুসলিম বন্দিশিবিরগুলোকে ‘ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ২০১৬ সালের পর থেকে এই বন্দিশিবিরগুলোর আকার আগের চেয়ে অনেক দ্রæত বেড়েছে। এখনো বন্দিশিবিরের বাইরে থাকা মুসলিমদের ব্যাপক সরকারি নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে জাতিসংঘ জানিয়েছে, ১০ লাখেরও বেশি উইঘুর মুসলিমকে আটক রেখে তাদের ধর্ম পালনে বাধা দেয়া হচ্ছে। বলপূর্বক তাদের কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শে বিশ্বাস স্থাপন করানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে নিজ ধর্মের সমালোচনা করতে তাদের ওপর বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের শপথ করতে হচ্ছে বস্তুবাদে বিশ্বাসী ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্যের, যা ইসলামের বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেই ধারাবাহিকতায় সরকার ইসলামকে তাদের কথিত সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে উদ্যোগী হয়েছে। এর অংশ হিসেবেই মুসলিমদের ওপর ধরপাকড়ের পাশাপাশি চীন থেকে আরবি ভাষা ও ইসলামি প্রতীক মুছে দিতে উদ্যোগ নিয়েছে বেইজিং।
২০১৭ সালে জিনজিয়াংয়ে ফিরে আসা সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করা হয়েছিল সে সম্পর্কেও নির্দেশাবলী দলিলগুলোতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সংবাদপত্রের মতে, চীনের কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের বলেছিল যে তাদের পরিবারের সদস্যরা ইসলামিক উগ্রপন্থার ‘ভাইরাস’ দ্বারা ‘সংক্রামিত’ এবং তাদের নিরাময়ের প্রয়োজন। ফলে তারা যদি অধ্যয়ন এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করে তবে তারা ধর্মীয় উগ্রবাদগুলোর বিপদ সর্ম্পকে কখনই পুরোপুরি বুঝতে পারবে না। তাই বয়স যাই হোক না কেন, যে কেউ ধর্মীয় উগ্রবাদ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তাকে অবশ্যই অধ্যয়ন করতে হবে।