এই তো ক’দিন আগে আমার প্রিয় দেশ ছেড়ে প্রবাসী হয়েছি। দেখতে দেখতে জীবন থেকে অতীত হয়ে গেছে দশটি শীতল মৌসুম। পছন্দের খেজুর রসের ঘ্রাণ আমাকে টানে। কিন্তু পারি না স্বাদ মেটাতে। প্রবাসে কর্মব্যস্ত জীবনে ঘামের গন্ধে নাসিকা অনুভব করতে ভুলে গেছি খেজুর রসের মৌ মৌ গন্ধ। ভুলে গেছি সকালবেলা গরম ভাতে সরিষা শাকের নাক জ্বলানো ঝাঁঝ।
প্রবাসে থেকে কতকিছুর স্বাদ যে ভুলে গেছি। প্রবাস মানে অনেককিছু ভুলে থাকা। সময় ভাগ্য নিয়ে খেলা করে। আমরা প্রবাসীরা সব ভুলে থাকতে শিখি। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় যারা প্রবাসে পাড়ি জমায় তাদের প্রত্যেকের জীবনে কিছু না কিছু স্বপ্ন আছে। প্রবাসীরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। নিজে স্বপ্ন দেখে পরিবারের সদস্যদের স্বপ্নের পৃথিবীতে বিচরণ করার সুযোগ করে দেয়। প্রতিটা প্রবাসীর হৃদয়ে গল্পেরা অমর হয়ে থাকে।
আমার এক পরিচিতজনের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা হলে আমার সাথে কথা হয়। সে বলে ভাই আমার মা-বাবা, স্ত্রী, ভাই-বোনকে নিয়ে অনেক ভাবি। ওদের সাথে থাকতে খুবই ইচ্ছা হয়। কিন্তু পারি না। জীবনে কোনো হাসি-আনন্দ নেই। নিজে কষ্টে থাকলেও পরিবারের লোকদের বুঝতে দিই না। আমি সবসময় তাদের বলে থাকি ভালো আছি।
আমি বললাম তাদেরকে কেন মিথ্যা বলেন? সে বলল, আমি ভালো আছি সেই কথা যদি না বলি, তারা চিন্তায় থাকবে। সেজন্য মিথ্যা বলি। কিন্তু তারা আমার মনের অবস্থা একটিবারও বুঝতে পারে না! বুঝতে চায়ও না। আমি যা বলি তারা তাই বিশ্বাস করে।
যখন টাকা-পয়সা নিয়ে কথা হয় তখন আর তারা বিশ্বাস করতে চায় না। পরিবারের লোকেরা ভাবে আমি মিথ্যা বলছি। তারা যখন আমাকে অবিশ্বাস করে তখন খুবই কষ্ট পাই। আমি আর কিছুই বলি না। চুপচাপ থাকি।
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলাম। কথাগুলো কান্না জড়িত কণ্ঠে সে আমাকে বলল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ দুটি ভারি হয়ে আসছিল। বেশিক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। আমি তাকে শান্ত্বনা দিয়ে তার পাশে বসলাম। তার অন্য আরো কথা আমাকে বলতে লাগল। আমিও শুনতে লাগলাম।
সত্যি প্রবাসীদের ভাবার কোনো শেষ নেই। পরিবারের সবার সুখই তাদের সুখ। নিজে ভালো থাকতে কখনো চাই না। নিজে ভালো থাকা মানে স্বার্থপর হওয়া। সবাইকে আলাদা করে দেওয়া। আলাদাভাবে কখনো কোনো কিছু ভাবে না। সবার সাথে থাকা মানে সুখের স্বর্গে থাকা।
প্রবাসীরা কখনো আলাদাভাবে ভাবতে পারে না। বরং একটা সময় আপনজনেরা প্রবাসীকে আলাদাভাবে ভাবতে শেখে। এবং ভাবেও। তারপর অবহেলায় বঞ্চিত করে রাখে সকল সুখের দুয়ার হতে। ঠিক যেন একটি ফলন্ত গাছ কেটে ফেলবার মতো।
আমার এক পরিচিতজন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ভাই অনেকদিন হলো দেশে যাই না। দেশে যাওয়ার জন্য মনটা ছটফটিয়ে ওঠে কিন্তু পারি না। যখন কাউকে দেশে যেতে দেখি তখন আপনজনদের জন্য মনটা কেঁদে ওঠে। মনটাকে খুব কষ্টে বুঝিয়ে স্থির করে রাখি। অবুঝ মন কিছুতেই বুঝতে চায় না। তারপরও বুঝিয়ে পড়ে থাকি পরবাসে। মা-বাবার ওষুধের টাকা, ভাই-বোনের লেখাপড়ার টাকা সব আমারই বহন করতে হয়। মন চাইলেও সবসময় আর যাওয়া যায় না।
দেশে যাওয়ার জন্য মন স্থির করলাম। বিমানের টিকিট বুকিং দিলাম। প্রবাসীরা দেশে গেলে আপনজনদের জন্য কিছু না কিছু সঙ্গে নিয়ে যায়। কেন নিয়ে যায় জানি না। তবে জানি প্রবাসীদের একটা দায়বদ্ধতা আছে, সেই দায়বদ্ধতার কারণে নিতে হয়। আমিও সময়-সুযোগ মতো কিছু কেনাকাটা করতে লাগলাম। কার কী পছন্দ সেই মোতাবেক কেনাকাটা করতে লাগলাম। কেনাকাটা করি আবার কি যেন ভুলে যাই। এমনভাবে দিন কাটতে লাগল।
দিন যতই এগিয়ে আসছে মনের মধ্যে মহানন্দের জোয়ার ততই ঢেউ খেলে যাচ্ছে। এ যেন শুধু ভালোলাগা। ঈদের খুশি, এ খুশির কাছে অতি নগন্য। দেহটা পড়ে থাকে পরবাসে কিন্তু মনটা বিচরণ করে আপন দেশে। আমার মনটাও আপন দেশে আপনজনদের কাছে চলে যায় আবার ফিরে আসে। হঠাৎ ঘুমের ভেতর মাঝেমধ্যে জেগে উঠি আর দিন গুনি। দেশে যাওয়ার অনুভূতি শুধু অনুভুতি নয়, এ যেন এক পাগল অনুভূতি।
দায়িত্ব মানুষকে নত হতে শেখায়। দায়িত্ব পালন করতে করতে আকুতি গোপন থাকে। প্রবাসীর ভুল পরিবারের কাছে ক্ষমার অযোগ্য। নিজের সমস্ত কাজ নিজেরই করতে হয়। বাজার করা, রান্না করা, কাপড়-চোপড় ধোয়া এসব প্রতিদিনের কাজ। আবার একটি সকাল হয় সন্ধ্যা আসে।
প্রবাসীর বলতে না পারা অনেক কথায় চাপা থাকে। সেসব পঁচা কথা কেউ শুনতে চায় না। প্রবাসীর প্রবাস নামের ডিঙ্গি ভাসতে ভাসতে নিজের সাথে নিজেই অট্টহাসি দিয়ে হেসে ওঠে।
সাইফ তমাল, সিঙ্গাপুর থেকে