সুমন থেকে সুমি, রবিউল থেকে চুমকি, শান্ত থেকে শান্তা কিংবা মাসুদ থেকে মাসুমা। এরা সবাই একটি বয়স পর্যন্ত ছেলে ছিল। তারপর একটি সংঘবদ্ধ চক্র এদেরকে নানান প্রলোভন দেখিয়ে পুরুসাঙ্গ কেটে হরমোন ইনজেকশন পুশ করে মেয়েতে রূপান্তর করে। এরপর সমাজে তাদের পরিচয় হয় হিজড়া হিসেবে। তাদেরকে দিয়ে করানো হয় বিভিন্ন ধরনের অপরাধ।
আর যারা এসব অপরাধের নেপথ্যে কাজ করছে তারা রাতারাতি হয়ে যায় কোটিপতি। দামি গাড়ি আর বিলাসবহুল বাড়ি বানিয়ে তারা বিলাসী জীবনযাপন করে। প্রতিদিন এসব হিজড়া গডফাদারদের আয় কয়েক লাখ টাকা। আর অসহায় এসব হিজড়ারা না পারে পরিবারের কাছে ফিরে যেতে, না পারে অপরাধের জগৎ থেকে বের হতে!
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর মগবাজার, খুলনার নোয়াপাড়া এবং সাভারের একটি ক্লিনিকে পুরুষাঙ্গ কাটার কাজ করে কতিপয় অসাধু চিকিৎসক। হরমোন ইনজেকশন পুশ করে ছেলেদের শরীরে নারীর শারীরিক লক্ষণ ফুটিয়ে তুলতে ব্যয় হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। বনানীতে এই কাজটি করা হয়। প্রাথমিকভাবে হিজড়া সরদাররা এই টাকা বিনিয়োগ করে। পরবর্তীতে ওইসব হিজড়াদের দিয়ে সারা জীবন অবৈধ কাজ করিয়ে অর্থ আদায় করে নেয় তারা।
সুমি নামে এক হিজড়া জানান, ১০-১২ বছর আগে তিনি কাওরানবাজারে শ্রমিকের কাজ করতেন। ওইসময় তার নাম ছিল সুমন। তার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পূর্ব ইজদাইল গ্রামে। চার ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। পরিবারে অভাবের কারণে তিনি শ্রমিকের কাজ করতেন। ছোটবেলা থেকেই তার আচরণে ছিল লাজুকতা এবং কিছুটা মেয়েলিপনা। আর এই বিষয়টিই একসময় নজরে পড়ে স্বপ্না হিজড়ার লোকজনের। তারা নানা প্রলোভন দেখাতে থাকে সুমনকে। একসময় তারা সুমনকে নিয়ে যায় অন্য হিজড়াদের কাছে। সেখানে তাকে দেখানো হয় হিজড়ারা তার চাইতেও কত বেশি টাকা আয় করছে। কত বিলাসী জীবনযাপন করছে তারা।
এক পর্যায়ে সুমনকে তারা মেয়ে-হিজড়া হওয়ার প্রস্তাব দেয়। মেয়ে হলে কত সুবিধা তাও বোঝানো হয় তাকে। সুমনও এক সময় রাজি হয়ে যান। ওইসময় তার বয়স ছিল ১২-১৪ বছর। এরপর তার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হয় মগবাজারের কোনো এক ক্লিনিকে। তবে ওই ক্লিনিকের নাম বলতে পারেননি তিনি। পুরুষাঙ্গ কাটার কিছুদিন পর তাকে বনানীর আরেক ক্লিনিকে নেয়া হয়। সেখানে বেশ কিছুদিন ইনজেকশন পুশ করা হয় তার শরীরে। এভাবে তার শরীরে নারীর লক্ষণ ফুটিয়ে তোলা হয়। এরপর তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সুমি। নামিয়ে দেয়া হয় রাস্তায়, টাকা তোলার কাজে।
সুমি জানান, প্রতিদিন শুধু কাওরানবাজার থেকেই তারা কয়েকজন মিলে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা তোলেন। এ ছাড়া নাবিস্কো, মগবাজার, তেজগাঁও, মধুবাগ ও রমনা এলাকা থেকে স্বপ্নার নিয়ন্ত্রণাধীন হিজড়ারা দৈনিক ৫০ হাজার টাকা তোলে।
আরেক হিজড়া চুমকি জানান, ৮-১০ বছর আগে তার নাম ছিল রবিউল। মহাখালীর কাঁচাবাজারের ভেতর একটি হোটেলে বয়ের কাজ করতেন তিনি। সেখানে প্রায়ই কিছু হিজড়া খাবার খেতে আসত। ওই হিজড়ারাই তাকে একই ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়ায় পরিণত করে।
মাসুমার নাম ছিল মাসুদ। তিনি কাজ করতেন একটি পোশাক তৈরির কারখানায়। স্বভাবে মেয়েলিপনা থাকায় তাকেও টার্গেট করে স্বপ্না হিজড়ার লোকজন।
বাড্ডার নতুন বাজারে নির্মাণকাজ করতেন ১৫ বছরের শান্ত। হিজড়াদের ভাষায় তার স্বভাবে ‘মাইগ্গা’ (মেয়েলিপনা) ভাব থাকায় তাকেও প্রলোভন দেখিয়ে হিজড়াতে রূপান্তর করা হয়।
হিজড়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রলোভন দেখিয়ে কিংবা জোর করে অসংখ্য মেয়েস্বভাবের দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের ধরে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়ায় পরিণত করা হচ্ছে। এরপর এসব হিজড়াদের দিয়ে মাদক ব্যবসা, অস্ত্র বহন কিংবা ছিনতাইয়ের মতো অপরাধকর্ম করানো হচ্ছে।
তবে হিজড়া সরদার স্বপ্না হিজড়া তার বিরুদ্ধে করা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘কখনোই একজন পুরুষকে নারী কিংবা একজন নারীকে পুরুষে পরিণত করা যায় না।’
কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর এবং চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ এসএম জাকারিয়া বলেন, ‘প্রত্যেক পুরুষের ভেতর সামান্য পরিমাণে মেয়েলি হরমোন এবং প্রত্যেক নারীর ভেতর স্বল্প পরিমাণে পুরুষের হরমোন থাকে। কোনো পুরুষকে যদি ক্রমাগত মেয়েলি হরমোন ইনজেকশন পুশ করা হয় তবে তার ভেতর পুরুষের বৈশিষ্ট্য কমে যাবে এবং মেয়েলি বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি পাবে। ওই পুরুষের ভেতর মেয়েলি শারীরিক বৈশিষ্ট্যও ফুটে উঠতে থাকবে। উল্টোভাবে মেয়েদের শরীরে পুরুষের হরমোন ইনজেকশন পুশ করলেও তার ভেতর পুরুষের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠবে। ওই নারীর গোঁফ-দাড়ি গজাবে। তার গলার স্বর পুরুষের মতো ভারী হতে থাকবে।’(বাংলামেইল)